বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক: কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি

বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশি পোশাক তিন ডলারে কিনে তা বিক্রি করছে তিন থেকে চারগুণ বেশি দামে। তারপরও তারা পণ্যের দাম কমাতে কারখানাগুলোকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে পাঁচ ডলার দামের একটি শার্ট ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায় অন্তত ২৮ ডলারে বিক্রি হয়। জাহাজীকরণ, গুদাম, শুল্ক ও অন্যান্য পরিচালন খরচ যোগ করলে তা ১৬ ডলার হয়। বিদেশি খুচরা বিক্রেতারা শার্টপ্রতি প্রায় ১২ ডলার মুনাফা করতে পারে।
পশ্চিমের খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো প্রায়শই জাহাজের খরচ, গুদাম খরচ, ক্ষতিপূরণ ও বিজ্ঞাপনসহ অন্যান্য খরচের কথা বলে পণ্যের দাম কমানোর বিষয়ে তাদের দাবিকে যৌক্তিক করার চেষ্টা করেন।
ফতুল্লা অ্যাপারেলসের স্বত্বাধিকারী ফজলে শামীম এহসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অবশ্যই বাড়তি খরচ হয়, তবে তাদের মুনাফা হচ্ছে না এমন ভান করা উচিত নয়। অনেক ব্র্যান্ড বাংলাদেশের মাঝারি ও বেশি দামের পণ্য থেকে প্রচুর মুনাফা করে।'
তারপরও অনেক ক্রেতা বাংলাদেশের কারখানাগুলোকে দাম আরও কমানোর জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে।
ইউরোপের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশনের ২০২০ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৩৯ শতাংশ পোশাক প্রস্তুতকারক লোকসানে পণ্য বিক্রি করেছে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, মূলত বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে ও ভবিষ্যতে আরও কার্যাদেশ পেতেই তারা লোকসানে হলেও পণ্য বিক্রি করছেন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্য বলছে, একই ধরনের পণ্যের জন্য এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সব সময়ই কম দাম পায়।
২০২০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) প্রতি ১০০ কেজি সুতির টি-শার্ট রপ্তানি করে বাংলাদেশ এক হাজার ৯১ ইউরো পাঁচ সেন্ট পায়। এটি আগের বছরের তুলনায় এক শতাংশ কম। অন্যদিকে, একই রকমের পণ্যের জন্য ভিয়েতনাম পায় দুই হাজার ১৫৭ ইউরো নয় সেন্ট।
পুলওভার কাপড়ের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান আরও বেশি।
বাংলাদেশের একটি পুলওভারের গড় দাম সাত শতাংশ কমে এক হাজার ৩২৯ ইউরো পাঁচ সেন্ট হয়েছে। ভিয়েতনামের একটি পুলওভারের দাম দুই হাজার ১৫৭ ইউরো আট সেন্টে স্থির আছে।
বাংলাদেশের কৃত্রিম সুতা থেকে তৈরি পোশাকের দাম ছয় শতাংশ কমে এক হাজার ৩১৯ ইউরো চার সেন্ট হয়েছে। ভিয়েতনামের তিন শতাংশ কমে হয়েছে এক হাজার ৯০৬ ইউরো দুই সেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও একই ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে বলে সিপিডির তথ্যে জানা গেছে।
২০১৯ সালে বাংলাদেশে তৈরি এক ডজন সুতির টি-শার্টের গড় দাম ছিল ২২ ডলার ৪৩ সেন্ট। ২০২০ সালে তা ১৭ ডলার ৯৯ সেন্টে নেমে আসে। অর্থাৎ, ২০ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে, ভিয়েতনামের রপ্তানিকারকদের জন্য তা ৩৮ ডলার দুই সেন্ট থেকে কমে ৩১ ডলার নয় সেন্ট হয়েছে।
বাংলাদেশি সোয়েটার ও পুলওভারের দাম দুই শতাংশ কমে প্রতি ডজন ৩৯ ডলার ৩১ সেন্ট হয়েছে। ভিয়েতনামের সোয়েটার ও পুলওভারের দাম অপরিবর্তিত আছে।
ট্রাউজারের ক্ষেত্রে দামের ফারাক আরও বেশি। ২০২০ সালে বাংলাদেশে তৈরি নারীদের এক ডজন সুতির ট্রাউজারের দাম ছিল ৬৪ ডলার ১৭ সেন্ট। আগের বছরের তুলনায় তা ১২ শতাংশ কম। ভিয়েতনামের সেই পণ্যের দাম ৮৪ ডলার ছয় সেন্ট।
পদ্ধতিগত অবমূল্যায়ন
২০২২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমানোর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা পুরুষদের প্রতি পিস ট্রাউজারের দাম সাত ডলার শূন্য এক সেন্ট। বৈশ্বিক গড় দাম সাত ডলার ৭২ সেন্টের তুলনায় তা নয় দশমিক দুই শতাংশ কম। একই পণ্যে ভিয়েতনাম পেয়েছিল ১০ ডলার ৭৬ সেন্ট এবং শ্রীলঙ্কা ও ভারত পেয়েছিল আট ডলার ৪১ সেন্ট।
বাংলাদেশে তৈরি পুরুষদের সুতির জিনস বিক্রি হয়েছিল সাত ডলার ৮১ সেন্ট। এটি বৈশ্বিক গড় আট ডলার ৪১ সেন্টের তুলনায় সাত দশমিক দুই শতাংশ কম।
মাত্র দুটি বাংলাদেশি পণ্য—নারীদের সুতির ট্রাউজার ও পুরুষদের সুতির টি-শার্ট বৈশ্বিক গড় দামের তুলনায় সামান্য বেশি দামে বিক্রি হয়েছিল।
মেয়েদের সুতির ট্রাউজারের দাম ছয় ডলার ৪৩ সেন্ট। বৈশ্বিক গড় দাম পাঁচ ডলার ২২ সেন্ট। পুরুষদের টি-শার্টের দাম এক ডলার ৪৭ সেন্ট। বৈশ্বিক গড় দামের তুলনায় প্রায় ২৩ দশমিক এক শতাংশ বেশি।
তবুও, এই পরিসংখ্যানগুলো তুরস্ক ও পেরুর মতো দেশগুলোর আয়ের তুলনায় কম। একই পণ্যের জন্য তারা চারগুণের বেশি দাম পেয়েছিল।
আইটিসির তথ্য মতে, দামের এই ব্যবধান বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতার ইঙ্গিত দেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে পণ্যের মানের উন্নতি হলেও দর কষাকষির দক্ষতা কম।
খুচরা বিক্রেতারা উচ্চ পরিচালন খরচের কথা বলছেন
ফতুল্লা অ্যাপারেলসের স্বত্বাধিকারী ফজলে শামীম এহসান আরও বলেন, 'বাংলাদেশে উৎপাদিত জ্যাকেট ও আউটারওয়্যার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর কাছে বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ ডলারে। পরে তারা তা খুচরা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন ১০০ থেকে ১১০ ডলারে।'
তিনি মনে করেন, 'বাংলাদেশকে মূল উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের অনেক ধনী ব্যক্তি পোশাক পণ্য খুচরা বিক্রি করে তাদের ভাগ্য গড়েছেন।'
প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মধ্যস্থতাকারী বা তৃতীয় পক্ষ পরিচালন করে। পণ্য দোকানে পৌঁছার আগেই তারা তাদের ভাগ নিয়ে নেয়।'
তিনি আরও বলেন, 'অনেক সময় আমরা একটি টি-শার্ট সাড়ে তিন ডলারে বিক্রি করি। সেটি একটি ব্র্যান্ডের স্টোরে বিক্রি হয় ৩৯ ডলারে। তবে সব সময় এই দাম থাকে না।'
তিনি আরও বলেন, 'ঋতু ও পণ্য ভেদে দাম পরিবর্তিত হতে পারে। নিয়ম হচ্ছে, বেশিরভাগ পোশাক সার্বিক খরচের তিন থেকে চারগুণ বেশি দামে বিক্রি হয়।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউরোপীয় খুচরা বিক্রেতা জানান, পোশাক সরবরাহ ব্যবস্থায় একজন ইউরোপীয় খুচরা বিক্রেতাকে পণ্য রাখার জন্য বড় গুদাম ভাড়া নিতে হয়। তা অনেক ব্যয়বহুল।
তিনি আরও জানান, খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো একটি চালানের সর্বাধিক ৭০ শতাংশ পণ্য বিক্রি করতে পারে। মৌসুম শেষে অবিক্রীত পণ্য আর দোকানে তোলা হয় না।
তার মতে, ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলো এশীয় ব্র্যান্ডগুলো তুলনায় বেশি দাম দেয়। ফলে তাদের মুনাফা কম হয়। শেষ পর্যন্ত, ইউরোপীয় খুচরা বিক্রেতারা বার্ষিক ১০ শতাংশেরও কম মুনাফা করে।
ন্যায্য দাম ধরার আহ্বান
পোশাক শিল্পের সমর্থক ও বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়ই উৎপাদকদের আরও ন্যায্য দাম দেওয়ার জন্য বিদেশি ক্রেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে।
আইটিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—ডিজাইন, লজিস্টিকস ও ব্র্যান্ডিংয়ের সঙ্গে জড়িত পোশাক উৎপাদন ব্যবস্থা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। তবে বাংলাদেশের মতো যেসব দেশ শুধু কাপড় কাটে ও সেলাই করে সেসব দেশগুলো কম দাম পায়।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশের মতো একই এইচএস কোড শেয়ার করলেও চীন ও ভিয়েতনাম কাপড়ের বৈচিত্র্যময় উদ্ভাবনী ডিজাইনের কারণে তাদের পোশাকের বেশি দাম পাচ্ছে।'
তার মতে, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি মাত্র পাঁচ বা ছয়টি পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এটি বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৭০ শতাংশ। এর ফলে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে এ দেশের রপ্তানিকারকদের পণ্যের দাম কমাতে হয়।
তার মতে, তুলার ওপর পোশাক শিল্পের অতিমাত্রায় নির্ভরতা ও কৃত্রিম সুতার সীমিত ব্যবহারও পণ্যের ভালো দাম না পাওয়ার কারণ।
সিপিডি গবেষণা পরিচালক আরও বলেন, 'আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আনা কার্যকর সমাধান হতে পারে। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত দামি ক্রেতা ও উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা পান।'
Comments