মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা পাঠানো আরও সহজ হলো

আর্থিক পরিষেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আজ সোমবার থেকে আন্তলেনদেন চালু হয়েছে। এতে করে একটি নির্দিষ্ট মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অপারেটরের গ্রাহক অন্য অপারেটর বা ব্যাংকে সহজেই টাকা পাঠাতে পারবেন।
এমএফএস

আর্থিক পরিষেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আজ সোমবার থেকে আন্তলেনদেন চালু হয়েছে। এতে করে একটি নির্দিষ্ট মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অপারেটরের গ্রাহক অন্য অপারেটর বা ব্যাংকে সহজেই টাকা পাঠাতে পারবেন।

গতকাল পর্যন্ত যে নিয়ম ছিল, তা অনুযায়ী, বিকাশের গ্রাহকরা রকেট বা অন্য কোনো এমএফএস অপারেটরে টাকা পাঠাতে পারতেন না। পাশাপাশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর সুযোগও সীমিত ছিল।

একইভাবে একটি নির্দিষ্ট ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হোল্ডাররাও অন্য ব্যাংকে টাকা ডিজিটাল লেনদেন করতে পারতেন না।

তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত আন্তলেনদেনযোগ্য ডিজিটাল লেনদেন প্ল্যাটফর্ম (আইডিটিপি) বিনিময় চালু হওয়ায় এখন সহজেই যেকোনো এমএফএস অপারেটর বা ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করা যাবে।

বাংলাদেশে এমএফএস চালু হওয়ার ১ দশকেরও বেশি সময় পর শুরু করা এই নতুন ব্যবস্থাটি এমএফএস, ব্যাংক ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের মধ্যে অর্থ লেনদেনের সুবিধা ও নগদবিহীন লেনদেনের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে তুলবে।

একাধিক এমএফএস অ্যাকাউন্ট হোল্ডার আজিজুল হায়াত দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা আমার জন্য দারুণ খবর। এর ফলে অনেক উপকার হবে।'

'এমনকি যদি আমি একটি পণ্য কিনতে চাই, তবে একটি এমএফএস অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স না থাকলেও আমি অন্যান্য এমএফএস অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ স্থানান্তর করতে পারব', বলেন তিনি।

বাংলাদেশে ২০১১ সালে এমএফএস সার্ভিস চালু হয়। কিন্তু, এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটর বা ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তর করতে অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের ১২ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো।

বর্তমানে, ১৩টি এমএফএস অপারেটরের ১৮ কোটিরও বেশি অ্যাকাউন্ট হোল্ডার রয়েছে। এর মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়ে থাকে।

গতকাল, ৩টি এমএফএস অপারেটর নিয়ে আইডিটিপি যাত্রা শুরু করে। সেগুলো হলো— বিকাশ, রকেট ও এমক্যাশ। একটি ওয়ালেট ট্যালিখাতাসহ ১০টি ব্যাংকও এ তালিকায় আছে। ব্যাংকগুলো হলো— রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইউসিবি, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও মিডল্যান্ড ব্যাংক।

প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় গতকাল রাজধানীর রেডিসন ব্লু ঢাকা ওয়াটার গার্ডেন হোটেলে 'বিনিময়' এর উদ্বোধন করেন। সেসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ক্রমান্বয়ে অন্যান্য ব্যাংক ও এমএফএস অপারেটরদেরও এ তালিকায় যোগ করা হবে।

আইসিটি বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ইনোভেশন অ্যান্ড এন্টাপ্রিনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট অ্যাকাডেমি প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে প্ল্যাটফর্মটির উন্নয়নে সহযোগিতা করেছে ভেলওয়্যার লিমিটেড, মাইক্রোসফট বাংলাদেশ ও ওরিয়ন ইনফরমেটিকস লিমিটেড।

বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল কাদীর বলেন, 'বিনিময় বাস্তবায়নে শুরু থেকেই বিকাশ নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। বিনিময়ের পাইলট প্রকল্পেও অংশ নিয়েছে বিকাশ'

'আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইসিটি বিভাগের এই প্রযুক্তিগত ইন্টিগ্রেশন উদ্যোগ গ্রাহকদের ক্ষমতায়ন করবে এবং তাদের আর্থিক লেনদেনে আরও স্বাধীনতা দেবে', বলেন তিনি।

এক এমএফএস অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরে অর্থ স্থানান্তরে প্রতি ১ হাজার টাকায় ৫ টাকা খরচ হবে। একই পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে স্থানান্তর করতে খরচ হবে ১০ টাকা।

এমএফএস থেকে পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারের অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করতে খরচ হবে ৫ টাকা।

কীভাবে কাজ করে

প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করতে হলে গ্রাহকদেরকে তাদের ব্যাংক, এমএফএস বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিনিময়ের সঙ্গে নিবন্ধন করতে হবে।

একবার নিবন্ধিত হয়ে গেলে, তারা একটি ভার্চুয়াল আইডি (ভিআইডি) পাবেন। যেমন: karim@binimoy। আবার মার্চেন্টদের জন্য ভিআইডি দেওয়ার অপশনও সেখানে আসবে।

বিনিময় ব্যবহারকারীদের ২ ধরনের লেনদেন করার অনুমতি দেবে। একটি হলো ডিরেক্ট পে (ডিপি), যার মাধ্যমে একজন গ্রাহক অন্য অ্যাকাউন্টে অর্থ পাঠাতে পারবেন। অন্যটি হলো রিকোয়েস্ট টু পে (আরটিপি), যা ব্যবহার করে একজন গ্রাহক অন্যান্য অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ পাবেন।

গ্রাহকরা তাদের বিনিময় প্রোফাইলে একাধিক অ্যাকাউন্ট যুক্ত করতে সক্ষম হবেন এবং ডিফল্ট অ্যাকাউন্ট হিসেবে একটি নির্বাচন করতে হবে।

ডিপি পদ্ধতির মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন (ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি বা ব্যক্তি থেকে ব্যবসা), সরকারি তহবিল বিতরণ (সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পেমেন্ট), বেতন দেওয়া (সরকারি ও করপোরেট), সরকারি বকেয়া অর্থ প্রদান (আয়কর, ফি, শুল্ক ও ভ্যাট), ইউটিলিটি বিল প্রদান ও কিউআর কোড-ভিত্তিক অর্থ প্রদান করা যাবে।

প্রতিটি লেনদেনের জন্য গ্রাহককে ৬ সংখ্যার পিন ব্যবহার করতে হবে। নিবন্ধনের সময়েই ব্যবহারকারীরা এ পিন পাবেন।

তথ্য আদান-প্রদানের সময় বিনিময় সিস্টেমে ৩ স্তরের নিরাপত্তা থাকবে: লেনদেনের নিরাপত্তা (মাল্টি-ফ্যাক্টর প্রমাণীকরণ), বার্তা নিরাপত্তা ও চ্যানেল নিরাপত্তা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃত মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারকারী শনাক্ত, পিন ও ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড যাচাইকরণের মাধ্যমে লেনদেন হওয়ায় প্রযুক্তিগতভাবে বিনিময় সুরক্ষিত।

এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

বিডিজবস ও আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম ফাহিম মাশরুর বলেন, 'এটা সবচেয়ে ভালো মুহূর্ত।'

তবে, উদ্বেগও রয়েছে।

ফাহিম মাশরুর বলেন, 'ব্যবহারকারীদের মধ্যে এটি জনপ্রিয় করে তোলাই হবে চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে সাধারণ ব্যবহারকারী, যারা অল্প পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর বা প্রদান করেন।'

'একজন ব্যবহারকারীকে ১ হাজার টাকা পাঠাতে অতিরিক্ত ৫ টাকা দিতে হবে। এ প্ল্যাটফর্মটি জনপ্রিয় করার জন্য অন্তত ১ বছরের জন্য এই অতিরিক্ত ফি প্রত্যাহার করা উচিত। একবার পরিষেবাটি জনপ্রিয় হয়ে গেলে তারপরে এই ফি চালু করা যেতে পারে', বলেন তিনি।

প্ল্যাটফর্মটির নিয়ম অনুযায়ী, প্রেরক ও প্রাপক উভয়কেই বিনিময়ে নিবন্ধন করতে হবে। কিন্তু, শুধু প্রেরকদের ক্ষেত্রেই এ নিয়ম থাকা উচিত বলে মনে করেন মাশরুর।

ট্যালিখাতা ও ট্যালিপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত খান বলেন, 'যেহেতু আমরা ছোট ব্যবসা ও মার্চেন্টদের জন্য ডিজিটাল ওয়ালেট হিসেবে কাজ করি, তাই আমাদের ব্যবসায়ীরা যেকোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ডিজিটাল ওয়ালেট ব্যবহার করে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করতে পারেন এবং সব সরবরাহকারীকে অর্থ প্রদান করতে পারেন।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সার্ভিস বিভাগের পরিচালক মো. মেজবাউল হক বিনিময়কে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, 'বিনিময় ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহিত করবে এবং নগদ লেনদেনকে নিরুৎসাহিত করবে। ফলে দেশকে নগদবিহীন করার পথ আরও প্রশস্ত হবে।'

গতকালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, 'একবার ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেলে লেনদেনের খরচ আরও কমে আসবে।'

Comments