দেশে খাদ্য উৎপাদন কমায় বাড়ছে আমদানি ব্যয়

এবার টানা চতুর্থ বছরের মতো অপর্যাপ্ত স্থানীয় উৎপাদনের কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানিতে বেশি অর্থ খরচ করছে বাংলাদেশ।
ফাইল ছবি

বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও খাদ্যপণ্যের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েই চলেছে। দেশে খাদ্য আমদানি ব্যয় এক দশক আগের তুলনায় আড়াই গুণ বেড়ে ৮০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চাল, গম, মসলা, ভোজ্যতেল, তৈলবীজ, ডাল, চিনি ও দুগ্ধজাত পণ্য কিনতে এই ৮০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে বেসরকারি ও সরকারি সংস্থাগুলো খাদ্য সামগ্রী আমদানিতে ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা ১ বছর আগের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ১০ শতাংশ বেশি।

অথচ, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৩ দশমিক ৮১ কোটি টন চাল উৎপাদন হয়েছে।

এবার টানা চতুর্থ বছরের মতো অপর্যাপ্ত স্থানীয় উৎপাদনের কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানিতে বেশি অর্থ খরচ করছে বাংলাদেশ।

কৃষি বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের ৮৮ দশমিক ২৯ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমি পরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনতে নীতিনির্ধারকদের মনোযোগের অভাব রয়েছে। ফলে, আমদানি নির্ভরতা এত বেশি।

'রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল পণ্য' হওয়ায় দেশের প্রতিটি সরকার চাল উৎপাদন বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং এর উন্নত জাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণায় আরও বেশি বরাদ্দ দিয়েছে।

কৃষি বিশ্লেষকদের মতে, বৈচিত্র্যময় কৃষি উৎপাদন করা হয়নি বা কম হয়েছে। এর ফলে, তৈলবীজ, ডাল ও দুগ্ধজাত পণ্যসহ অন্যান্য পণ্য নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে পর্যাপ্ত মনোযোগ পায়নি। এর ফলে এসব পণ্যের জন্য বিশ্ববাজারের ওপর দেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

এসব পণ্য উৎপাদনকারী বেশ কিছু দেশ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ ঘাটতি ও মূল্যের অস্থিরতা রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরের সপ্তাহগুলোতে বেশ কয়েকটি দেশ বিভিন্ন ধরণের খাদ্য পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়, বাড়তি কর আরোপ করে।

ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটের একটি ব্লগ পোস্ট অনুসারে, এ ধরনের উদ্যোগ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্য বৃদ্ধির কারণ হয়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'বাংলাদেশ উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতির নীতি অনুসরণ করলেও অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া উচিত। তা না করলে করোনা মহামারি ও ডলার সংকটের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করব কীভাবে?'

বিভিন্ন পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গত ১ বছর ধরে ডলার সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ।

অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'বাংলাদেশের উচিত আমদানি নির্ভরতা কমাতে প্রধান খাদ্যপণ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা।'

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান ওয়াইস কবির বলেন, 'রাজনৈতিক মাত্রা বিবেচনায় সরকারকে ধান উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। এর জন্য আমরা ধান উৎপাদনে যথেষ্ট ভালো করছি।'

দেশে ধান নিয়ে সার্বক্ষণিক গবেষণা করছেন ৩০০ কৃষি বিজ্ঞানী। তবে, অন্যান্য খাদ্য পণ্য নিয়ে নিবেদিত গবেষণাকারী বিজ্ঞানীর সংখ্যা খুব বেশি নয়।

ওয়াইস কবির বলেন, 'বাংলাদেশে কৃষি জলবায়ুর সীমাবদ্ধতা, কম জমি এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার কারণে সব খাদ্যপণ্য উৎপাদন করা যায় না। এটা অন্যান্য দেশের জন্যও সত্য। তাই, আমাদের কিছু পণ্য আমদানি করতেই হবে এবং ভোক্তাদের আয় বৃদ্ধি পেলে এই আমদানিও বাড়বে।'

তিনি মনে করেন, সুষ্ঠু পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় অর্থাৎ দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

তিনি বলেন, 'এর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সহযোগিতা দৃঢ় করতে হবে।'

ওয়াইস কবিরের মতে, দক্ষিণাঞ্চলে নতুন উদ্ভাবিত স্বল্পমেয়াদী মুগ ডালের আবাদ বাড়িয়ে বাংলাদেশ ডাল আমদানি কমাতে পারে।

তিনি জানান, সরকার মানসম্পন্ন বীজের জন্য কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে এবং ডাল, মসলা ও তৈলবীজের মতো ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা জোরদার করতে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

ক্রমবর্ধমান দুগ্ধ শিল্পের মাধ্যমে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে নানান দুগ্ধজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।

ওয়াইস কবির বলেন, 'পনির ও মাখনের মতো উচ্চমানের দুগ্ধপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের উচিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। এর জন্য বাজারে প্রতিযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন হবে।'

সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক জানান, ৮টি প্রধান পণ্যের মধ্যে ভোজ্যতেল ও তেলবীজ আমদানি করতে একটি বড় অংশ ব্যয় হয়।

তিনি বলেন, 'সরকার রাইস ব্র্যান অয়েল ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করতে পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। কারণ অটো রাইস মিলগুলো সহজেই রাইস ব্র্যান অয়েল উত্পাদন করতে পারে।'

তিনি বলেন, 'বর্তমানে আমরা দেশে উৎপাদিত রাইস ব্র্যানের ২০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারি। বাকি ৮০ শতাংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।'

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম এ সাত্তার মণ্ডল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদন বহুমুখী করার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, 'এতে উৎপাদন বাড়বে এবং আমদানি কমাতে সহায়তা করবে।'

কৃষিখাতের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে সরকার ৭ হাজার ২১৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে।

অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'এর ফলে ফসলের বহুমুখী উৎপাদন বাড়বে।'

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭৩ শতাংশ ফসলি জমি ব্যবহৃত হয় ধান চাষে, যা অতীতে ৮০ শতাংশেরও বেশি ছিল।

অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'এটা ইতিবাচক। কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জ হলো উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। ধানের উত্পাদনশীলতা নিশ্চিত করার পরে, আমাদের অন্যান্য উচ্চমূল্যের ফসলের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।'

কৃষিমন্ত্রী মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'বাংলাদেশই একমাত্র দেশ নয় যারা উচ্চ মূল্যে খাদ্য আমদানি করছে। অন্যান্য দেশও একই পরিস্থিতিতে পড়ছে।'

তিনি জানান, প্রতি বছর দেশের জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ বাড়ছে, যার অর্থ খাদ্য চাহিদা বাড়ছে। একই সঙ্গে গৃহ নির্মাণের কারণে কৃষি জমি ক্রমশ কমছে।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, 'এটা একটা চ্যালেঞ্জ। জমি কমতে থাকায় বিজ্ঞানীরা ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাত তৈরির চেষ্টা করছেন।'

তার মতে, বাংলাদেশে গম উৎপাদন বৃদ্ধির অনুকূল আবহাওয়া নেই। তাই গমের জন্য আমদানির ওপর নির্ভর করতে হবে। তবে, ভুট্টা ও সরিষার উৎপাদন বৃদ্ধির বেশ ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। আগে আমন ধান কাটার পর সরিষা চাষ করা কঠিন ছিল।

আগে আমন ধান কাটার জন্য ১৪০-১৬০ দিন সময় লাগত। এখন, বিজ্ঞানীরা এর একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন, যা ১১০-১১৫ দিনের মধ্যে কাটা যাবে।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, 'এতে আমন ধান কাটার পর সরিষা চাষের সময় পাওয়া যাবে।'

বিজ্ঞানীরা সরিষার উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন, যার ফলন প্রতি একরে প্রায় ৮ থেকে ৯ মণ হবে।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, 'এ বছর আমাদের সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আগামী ৩ বছরের মধ্যে আমরা ভোজ্যতেলের আমদানি অর্ধেকে নামিয়ে আনতে চাই।'

তিনি বলেন, 'কিছু উচ্চ ফলনশীল জাতের ডাল রয়েছে। এগুলো ইতিমধ্যে বাড়ছে। আশা করি, এগুলো ভালো ফলাফল নিয়ে আসবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

6h ago