৪ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে মন্দ ঋণ বাড়ছেই, কমছে মুনাফা

‘যদি সব মন্দ ঋণের ঘোষণা দেওয়া হতো, তাহলে ব্যাংকগুলো লোকসানে থাকতো।’
‘যদি সব মন্দ ঋণের ঘোষণা দেওয়া হতো, তাহলে ব্যাংকগুলো লোকসানে থাকতো।’

রাষ্ট্রায়ত্ত ৪টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ২০২২ সালে খারাপ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২৯ শতাংশ। এর কারণ, করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ শ্রেণিবিন্যাস শিথিল এবং অদক্ষভাবে ঋণ বিতরণ অব্যাহত রাখা।

এর ফলে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের যৌথ মুনাফা গত বছর ২৪ শতাংশের বেশি কমে ৭০৩ কোটি টাকা হয়েছে।

আর্থিক বিবরণী অনুসারে, এই ৪ ব্যাংকের মন্দ ঋণ গত বছর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ১৬১ কোটি টাকায়, যা ২০২১ সালে ছিল ৩২ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। অনাদায়ী ঋণ ও ঋণ পরিশোধের জন্য সঞ্চিতি রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খেলাপিরা কিস্তির সংখ্যা বৃদ্ধি, ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং সুদ মওকুফসহ নানা রকমের নীতিগত সহায়তা পাচ্ছে। এই কারণে, অনেক ঋণগ্রহীতা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না।'

দেশে করোনা শনাক্তের পরে ২০২০ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণদাতাদের নির্দেশনা দেয়, ঠিকভাবে কিস্তি দিতে না পারলেও ব্যবসায়ীদের খেলাপি হিসেবে বিবেচনা না করতে। ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এই সুবিধা দেওয়া হয় ব্যবসায়ীদের। সুবিধাটি পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয় এবং ২০২২ সালেও এই সুবিধা ছিল।

বিশ্বব্যাংক গত মাসে জানিয়েছে, ঋণ শ্রেণিবিন্যাসে শিথিলতার অংশ হিসেবে খেলাপি ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২ বছর থেকে বাড়িয়ে ৮ বছর করা হয়েছে। ঋণ পুনর্নির্ধারণের জন্য নূন্যতম ডাউন পেমেন্ট কমিয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। খেলাপি ঋণ ৪ বার পর্যন্ত পুনর্নির্ধারণ করা যাবে।

বাংলাদেশের বৃহত্তম ঋণদাতা সোনালী ব্যাংকের মন্দ ঋণ ২০২২ সালে আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়ে ১১ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ, সোনালী ব্যাংক থেকে দেওয়া মোট ঋণের ১৪ শতাংশই মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে।

সোনালী ব্যাংকের নিম্নমানের ঋণ ১৩২ শতাংশ বেড়ে ৫১৯ কোটি টাকা হয়েছে এবং সন্দেহজনক ঋণ ২ শতাংশ কমে ১৬৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। মন্দ সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন ৫ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা হয়েছে।

শ্রেণীবিভাগের ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোকে সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ ও মন্দ ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়।

সুদ ও কমিশন থেকে আয় বৃদ্ধি পেয়ে সোনালী ব্যাংকের মুনাফা ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৪০৮ কোটি টাকা হয়েছে।

সোনালী ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ঋণগ্রহীতারা ২০২০ ও ২০২১ সালে ঋণের শ্রেণিবিন্যাসের সুযোগ পেয়েছেন এবং তা ২০২২ সালে কিছুটা সংকুচিত হয়েছে। এর ফলে মন্দ ঋণ বেড়েছে।

অগ্রণী ব্যাংকের অবস্থা সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ। অত্যধিক মন্দ ঋণ এবং সুদ ও কমিশন থেকে আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে।

অগ্রণী ব্যাংকের মুনাফা ২০২২ সালে ৩২ শতাংশ কমে ১৪১ কোটি টাকা হয়েছে। ব্যাংকটির মন্দ ঋণ ৬০ শতাংশ বেড়ে ১৪ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা হয়েছে।

নিম্নমানের ঋণ ১৩ শতাংশ বেড়ে ৭৯৯ কোটি টাকা এবং সন্দেহজনক ঋণ ২৫ শতাংশ কমে ২৭৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদের হার কম, তাই তাদের পোর্টফোলিওর তুলনায় মুনাফা কম।

তিনি বলেন, 'অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতে পেশাদার ব্যবস্থাপনার অভাবে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেশি হারে বাড়ছে।'

গত বছর জনতা ব্যাংকের মুনাফা ৫৬ শতাংশ কমে ১২৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ ২৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার ১১৯ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির নিম্নমানের ঋণ ৮৭ শতাংশ কমে ৪১ কোটি টাকায় এবং সন্দেহজনক ঋণ ৭০ শতাংশ কমে ৩৬ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

রূপালী ব্যাংকের মুনাফা ৪৪ শতাংশ কমে ২৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। খারাপ ঋণ ২২৮ শতাংশ বেড়ে ৮৫৮ কোটি টাকা হয়েছে।

ব্যাংকগুলো খেলাপিদের বিরুদ্ধে সময়মতো ব্যবস্থা নেয় না জানিয়েছে মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, 'এমনকি যখন ব্যাংকগুলো ব্যবস্থা নেয়, তখন ঋণগ্রহীতারা রিট করে এবং এসব ঋণের বিষয় দীর্ঘ সময় স্থিতাবস্থায় থাকে।'

তিনি জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার পর্যাপ্ত দক্ষতা নেই।

'অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তি না হওয়ায় ব্যাংকগুলো ভালো করছে কি না, তা নিয়ে ব্যাংকাররা মাথা ঘামান না। কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন যে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বন্ধ হতে দেবে না এবং প্রয়োজনে বেলআউট প্যাকেজ দেবে,' যোগ করেন তিনি।

সাবেক এই সচিব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে জবাবদিহিতার দাবি জানান।

তিনি মামলা দায়ের এবং জামানত বাজেয়াপ্ত করার মাধ্যমে মন্দ ঋণের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দিয়ে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত অর্থ মন্ত্রণালয়কে সঙ্গে নিয়ে প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করা এবং ঋণ সংক্রান্ত মামলা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিষ্পত্তি করার জন্য একটি উপায় খুঁজে বের করা।'

সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করায় রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্যের অবনতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই।

তিনি বলেন, 'ব্যাংকিংখাতে মন্দ ঋণ কমাতে সরকারকে আরও মনোযোগ দিতে হবে।'

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক ঋণ দিয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের নির্দেশে তারা বিভিন্ন খাতেও ঋণ দিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খানের মতে, এসব ঋণের অনেকগুলোই মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, ২০২২ সালে ঋণের শ্রেণিবিন্যাসের সুবিধা সংকুচিত হওয়ায় মন্দ ঋণের বাস্তব পরিস্থিতি আরও পরিষ্কার হচ্ছে। 'যদি সব মন্দ ঋণের ঘোষণা দেওয়া হতো, তাহলে ব্যাংকগুলো লোকসানে থাকতো।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ঋণগ্রহীতাদের করোনা মহামারির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করার জন্য ঋণের শ্রেণিবিন্যাসের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল।

তিনি বলেন, '২০২২ সালেও অনেক সুবিধা ছিল। তারপরও, মন্দ ঋণ বেড়েছে। অর্থাৎ সুযোগ না থাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো দক্ষতার সঙ্গে তা বিতরণ করতে পারেনি।'

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

8h ago