অ্যাননটেক্সের ঋণ: সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিলের নির্দেশ, সংকট বাড়বে জনতা ব্যাংকের

রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংককে ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অ্যাননটেক্স গ্রুপকে এই সুবিধা দিয়েছিল জনতা ব্যাংক।
জনতা ব্যাংক, অ্যাননটেক্স গ্রুপ, অ্যাননটেক্স গ্রুপের ঋণ, জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ,

রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংককে ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধা বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অ্যাননটেক্স গ্রুপকে এই সুবিধা দিয়েছিল জনতা ব্যাংক। কিন্তু এক অডিটে ঋণ কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর তা বাতিলের নির্দেশ দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী, জালিয়াতির শিকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটিকে অ্যাননটেক্সের কাছে পাওনা ৬ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে শ্রেণিকরণ করতে হবে।

গত ১ এপ্রিল এক চিঠিতে এসব নির্দেশ দিয়েছে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনতা ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এতে জনতার মোট খেলাপি ঋণ ২৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি দাঁড়াবে, যা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটিকে আরও সংকটে ফেলবে।

সম্প্রতি শেষ হওয়া ফাংশনাল অডিটের ফলাফল অনুযায়ী, অ্যাননটেক্সকে ৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধা অনুমোদন দিয়েছিল জনতা এবং ২০২২ সালের জুনে কোম্পানিটির ঋণ নিয়মিত হিসেবে রেকর্ড করেছিল। এক দশকেরও বেশি সময় আগে অনুমোদিত মূল ঋণের সঙ্গে জড়িত জালিয়াতি এবং কেলেঙ্কারির বিষয়টিও অডিটে উঠে এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির মাধ্যমে দেওয়া ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না এবং সুদ মওকুফ করা যাবে না।

অ্যাননটেক্সের ঋণকে নিয়মিত ঋণ হিসেবে রেকর্ড করে জনতা মূলত তার খেলাপি ঋণ কৃত্রিমভাবে কমিয়েছে, যদিও এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে।

গত ১ এপ্রিল জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে পাঠানো চিঠিতে ঋণের শ্রেণিকরণ ও এর বিপরীতে যথাযথ প্রভিশন রাখতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তারপর বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে জনতাকে ঋণ আদায়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ৬ হাজার ৫২৮ কোটি টাকার বিপরীতে জনতাকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হবে, যদিও ব্যাংকটির বোর্ড এখনো তার অনুমোদন দেয়নি।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, অডিটে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ অনুমোদনের প্রমাণ পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক এ নির্দেশনা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাঁচ বছরের জোরাজুরির পর গত বছরের জুলাইয়ে জনতা ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা খতিয়ে দেখতে অডিট প্রতিষ্ঠান আহসান কামাল সাদেক অ্যান্ড সিওকে নিয়োগ দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আব্দুল জব্বার।

তবে গতকাল মতিঝিলে নিজ কার্যালয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, 'সুদ মওকুফ সুবিধার পরও অ্যাননটেক্স এখনো ঋণ পরিশোধ করেনি।'

তিনি জানান, ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ এখন আরও বাড়বে, তাই তিনি উদ্বিগ্ন।

'এই মুহূর্তে জনতা ব্যাংক বড় কোনো ঋণের অনুমোদন দিচ্ছে না এবং আগের ঋণ আদায়ের চেষ্টা করছে,' বলেন তিনি।

২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অ্যাননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ হাজার ৫২৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। সুদসহ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা।

এই ঋণের পরিমাণ ঋণদাতার মূলধন ভিত্তির ২৫ শতাংশ অতিক্রম করে এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ এ নির্ধারিত একক ঋণগ্রহীতার সীমা লঙ্ঘন করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে জনতার ঋণ অনুমোদনে বড় আকারের অনিয়মের তথ্য উঠে এলে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটিকে একটি ফাংশনাল অডিট পরিচালনা করতে ও কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু জনতা এখনো কারো বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি।

জনতা ব্যাংকের বর্তমান আর্থিক অবস্থা

জনতা এক সময় বাংলাদেশের সুপরিচিত একটি ব্যাংক ছিল। কিন্তু অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের সঙ্গে জড়িত একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারিতে এর আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে।

২০১৭ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৫০১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ১৯ দশমিক ২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকটির মোট ঋণের ৭৫ শতাংশই পাঁচটি শাখায় কেন্দ্রীভূত, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

 

Comments