ব্যবসাক্ষেত্রে সংকট ও সুশাসনের অভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ

৩১ মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকায়।
ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয়েছে ১০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। সরকারি এই পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতের নেতিবাচক চিত্র পরিলক্ষিত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ৩১ মার্চ পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২১ কোটি টাকায়, যা এর ৩ মাস আগের তুলনায় ৯ শতাংশ এবং এক বছর আগের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি।

সর্বশেষ খেলাপি ঋণের এই পরিমাণটি ব্যাংকিং সেক্টরের ইতিহাসে দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টদের মতে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পেছনের কারণগুলো মধ্যে রয়েছে—করপোরেট সুশাসনের অভাব, ঋণ পরিশোধের শিথিল নীতি প্রত্যাহার, বর্তমান ব্যবসায়িক মন্দা ও বাংলাদেশি পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়া।

মার্চে ব্যাংকিং খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে খেলাপি ঋণের অনুপাত ছিল ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ডিসেম্বরে এই অনুপাত ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ ও গত বছরের মার্চে ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক শিল্প বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও গ্যাস সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে তারা যথাযথভাবে কাজও করতে পারছে না। সেই কারণে তারা ঋণও পরিশোধ করতে পারবে না।'

তার মতে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ঋণগ্রহিতারা ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে শিথিল নীতি পেলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বন্ধ করে দেওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।

কিছু ব্যাংক এখনো ডলার ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে ঋণগ্রহিতারা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্য, যন্ত্রপাতি কিংবা চাহিদামতো কিছু কেনার জন্য প্রয়োজনীয় ক্রেডিট লেটার খুলতে পারছেন না। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

অনেক উন্নত দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকায় দেশগুলোর নাগরিকদের ক্রয় ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা হয় অর্ডার বাতিল করছে কিংবা পণ্যের চালান স্থগিত করেছে।

বাংলাদেশি মূল রপ্তানি পণ্য গার্মেন্টস পোশাকের অর্ডারও কমে যাওয়ায় বার্ষিক রপ্তানি আয় ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ হ্রাস পেয়ে এপ্রিলে ৩ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। যদিও চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ের মধ্যে সামগ্রিক বিক্রি ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়ে ৪৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার হয়েছিল।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'স্থানীয় ও বৈশ্বিক উভয় বাজারেই নেতিবাচক অগ্রগতি স্থানীয় ব্যবসার ওপর আঘাত হেনেছে। সেই কারণেই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে কিছু ঋণ।'

খেলাপি ঋণের অনুপাত আর যাতে না বৃদ্ধি পায়, তাই ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে ঋণ বিতরণ করার আহ্বান জানান তিনি।

আন্তর্জাতিক গবেষকদের মতে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, ক্রেডিট বৃদ্ধিকে হ্রাস করে এবং আউটপুট পুনরুদ্ধারকে বিলম্বিত করে।

বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনাভাইরাস মহামারির সময় কিছু ব্যাংক ঋণগ্রহিতাদের সামর্থ্য বিবেচনা না করেই ঋণ দিয়েছিল। সেই ঋণগুলো খেলাপি ঋণে পরিণত হতে পারে।'

'খেলাপি ঋণের ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার পেছনে ব্যাংকিং সেক্টরে করপোরেট সুশাসনের অভাব আরেকটি প্রধান কারণ। আবার অর্থনীতি গভীর সংকটে রয়েছে। এর ফলেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে', বলেন তিনি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক এই কর্মকর্তা সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক উভয়কেই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করা উচিত এবং তাদের তালিকাভুক্ত করা উচিত।'

'খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সংকট সৃষ্টি করেছে। ফলে ঋণদাতারা নতুন ঋণের জন্য তহবিল ব্যবহার করতে পারছে না। এ ছাড়াও, ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন আকারে একটি মোটা পরিমাণ তহবিল আলাদা করতে হবে।'

খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করার জন্য একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের আহ্বানও জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, খেলাপি ঋণের ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ ৯টি রাষ্ট্র-চালিত ব্যাংকের কাছে ছিল, যার পরিমাণ মার্চ পর্যন্ত ৬২ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা এবং এর আগের বছরের তুলনায় তা ১৯ শতাংশ বেশি।

৪১টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৫ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা, যা ১৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে ৯টি বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক বছর আগের ২ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৪২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Houses for homeless: A project destined to fall into ruin

At least a dozen homes built for the homeless and landless on a river island in Bogura’s Sariakandi upazila have been devoured by the Jamuna while dozens of others are under threat of being lost.

2h ago