১০ বছরে খাদ্য সংরক্ষণ প্রকল্পের অগ্রগতি অর্ধেক

প্রকল্পের আওতায় সরকার বিভিন্ন জেলায় ৮টি সাইলো স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিল। যার মধ্যে দুটি গম সংরক্ষণে এবং বাকিগুলো চাল সংরক্ষণের জন্য।
মডার্ন ফুড স্টোরেজ ফ্যাসিলিটিজ প্রজেক্ট, খাদ্য অধিদপ্তর, সাইলো, বেক্সিমকো, টেক মাহিন্দ্রা লিমিটেড, টেক ভ্যালি নেটওয়ার্কস লিমিটেড,
নারায়ণগঞ্জে নির্মাণাধীন একটি সাইলো। সরকার প্রায় ১০ বছর আগে সারাদেশে ৮টি শস্য সাইলো নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, কিন্তু ভৌত অগ্রগতি এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০ শতাংশ। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি প্রকল্প 'মডার্ন ফুড স্টোরেজ ফ্যাসিলিটিজ প্রজেক্ট' শুরুর পর এক দশক পেরিয়ে গেলেও কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৫০ শতাংশেরও কম।

প্রকল্পের আওতায় সরকার বিভিন্ন জেলায় ৮টি সাইলো স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিল। যার মধ্যে দুটি গম সংরক্ষণে এবং বাকিগুলো চাল সংরক্ষণের জন্য। এছাড়াও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, দেশের ৬৩টি উপজেলার ৫ লাখ গ্রামীণ পরিবারকে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য ছোট ছোট সাইলো দেওয়া হবে। যেখান সংরক্ষিত খাদ্যশস্য ঘাটতির সময় বিক্রি বা খাওয়া যাবে।

পাশাপাশি অদক্ষতা কমাতে পরিবহন ও বাজার তদারকিসহ দেশের সামগ্রিক খাদ্য মজুত মনিটরিং ডিজিটালাইজড করতে হবে।

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটির খরচ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা।

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য মতে, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর অবহেলার কারণে সাইলোর নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি, ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়াও একই অবস্থায় আছে। ফলে, প্রকল্প ব্যয় ১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা থেকে ৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং বাস্তবায়নের জন্য আরও ২ বছর সময় চাওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আইএমইডি বলেছে, চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রায় ২৩ মাস অতিবাহিত হলেও সফটওয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো খাদ্য মজুত ও বাজার মনিটরিং সিস্টেম সরবরাহ করতে পারেনি।

ভারতের টেক মাহিন্দ্রা লিমিটেড এবং বাংলাদেশের টেক ভ্যালি নেটওয়ার্কস লিমিটেডের সহযোগিতায় বেক্সিমকো কম্পিউটারস লিমিটেড ২০২১ সালের জুনে ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিজিটালাইজেশন সিস্টেমের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।

চুক্তি অনুযায়ী, সফটওয়ারটি ১২ মাসের মধ্যে তৈরির কথা ছিল এবং প্রতিষ্ঠানগুলো আরও ২ বছর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবে।

তবে আইএমইডির গবেষণায় দেখা গেছে, চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী সফটওয়ার তৈরি করতে পারেনি।

আইএমইডি বলেছে, 'ডেভেলপাররা প্রয়োজনীয় সিস্টেম, অ্যাপ্লিকেশন এবং পণ্যের (এসএপি) লাইসেন্স পেতে বিলম্বের মুখোমুখি হওয়ায়- এটি আদৌ বাস্তবায়িত হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে।'

এছাড়া চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ে বিলম্বের বিষয়টি অবহিত করেনি

আইএমইডি বলছে, 'এ ক্ষেত্রে সফটওয়ার ডেভেলপারদের গাফিলতি আছে।'

আইএমইডি আরও বলেছে, 'সফটওয়ার সরবরাহের আগেই হার্ডওয়ার সরবরাহ করা হয়েছিল, যা কাম্য নয়।'

'ফুড স্টক অ্যান্ড মার্কেট মনিটরিং সিস্টেমের' মূল উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যশস্য সংগ্রহে স্বচ্ছতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে খাদ্য অধিদপ্তরকে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে ডিজিটালভাবে সংযুক্ত করা। কিন্তু, এখন পর্যন্ত মাত্র ২৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

বিলম্বের বিষয়টি স্বীকার করে প্রকল্প পরিচালক মো. রেজাউল করিম শেখ বলেন, 'বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সময়সীমা না মানায় বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও তারা এখনো সফটওয়ার ডেভেলপমেন্টের কাজ শেষ করতে পারেনি।'

তিনি বলেন, 'সাধারণত এসএপি লাইসেন্স পেতে মাত্র ৩ মাস সময় লাগে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সফটওয়ার ডেভেলপাররা জুনে আবেদন করলেও দেড় বছর পরে এটি পেয়েছে।'

বেক্সিমকো কম্পিউটারসের নির্বাহী পরিচালক মনজুরুল করিম খান বলেন, 'প্রয়োজনীয় লাইসেন্স পাওয়ার পর তারা এখন পুরোদমে সফটওয়ারটি ডেভেলপ করছেন।'

এখানে উল্লেখ করা দরকার, বেক্সিমকো কম্পিউটারসকে এসএপি লাইসেন্স পাওয়ার আগেই এপ্রিল মাসে আইএমইডি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে।

বিলম্বের কারণ নিয়ে খান বলেন, 'টেক মাহিন্দ্রার মাধ্যমে লাইসেন্স পেতে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সময় লেগেছে, কারণ তারা সে সময় অনুমোদনের জন্য অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষাসহ যথাযথ যাচাই-বাছাই করছিল।'

তিনি আরও বলেন, 'সফওয়ারটিতে অনেকগুলো অংশ আছে, যার মধ্যে দুটি অ্যাপ্লিকেশন সরবরাহ করা হয়েছে, যা ইতোমধ্যে সক্রিয় আছে।'

সফটওয়ারের কাজে বিলম্বের জন্য তিনি মার্কিন ডলারের ঘাটতিকেও দায়ী করেন।

'চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রগতি অনুযায়ী আইএমইডির রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়েছিল, তবে গত কয়েক মাসে আমাদের বড় অগ্রগতি হয়েছে। যদি বড় ধরনের কোনো চ্যালেঞ্জ না থাকে, তাহলে কয়েক মাসের মধ্যে কাজ শেষ হবে,' বলেন তিনি।

একইভাবে, ৫.৩৫ লাখ টনের সংরক্ষণ ক্ষমতাসহ ৮টি সাইলো নির্মাণের পরিকল্পনাও তুলনামূলকভাবে স্থবির হয়ে আছে।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, খুলনা, বরিশাল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৌশলগত অবস্থানে সাইলো নির্মাণের কথা ছিল। পরে স্থান নির্ধারণে সমস্যার কথা উল্লেখ করে ঢাকার সাইলো বাতিল করে খাদ্য অধিদপ্তর।

প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি মাত্র ৫০ শতাংশ। খাদ্য বিভাগ এই সময়সীমা পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রকল্পটি দুবার সংশোধন করা হয়েছে এবং ব্যয় প্রায় ৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

আইএমইডি বলেছে, 'প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ত্রুটি ছিল এবং নকশায়ও ভুল ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ হওয়ার পর জানা যায় ঢাকা সাইলো নির্মাণ করা সম্ভব নয়।

নির্মাণে বিলম্বের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, 'আমরা বারবার ঠিকাদারদের নোটিশ দিয়েছি, এমনকি সহযোগিতা না করলে তাদের চুক্তি বাতিলের হুমকিও দেওয়া হয়েছে।'

কিছুটা অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তারা ইতোমধ্যে দেশের ১৯টি বন্যাপ্রবণ জেলার পাঁচ লাখ পরিবারকে ক্ষুদ্র আকারের 'গৃহস্থালি সাইলো' বিতরণ করেছে।'

তিনি জানান, বাস্তবায়নে দীর্ঘ বিলম্বের কথা বিবেচনা করে পরিকল্পনা কমিশন বিশ্বব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।

Comments