নিত্যপণ্যের বাজার এখনো লাগামহীন কেন?

আমদানি করা বেশিরভাগ ডালজাতীয় পণ্যের দাম গত দুই মাসে সাড়ে ১৩ শতাংশ ও রোজার মাসের প্রথম নয় দিনে সাড়ে ২৩ শতাংশ বেড়েছে।
নিত্যপণ্যের দাম
পবিত্র রমজানেও ক্রেতারা নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি থেকে রেহাই পাননি। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

অত্যধিক দাম! অসহ্য!!

গত দুই বছরে দেশে জনগণের মধ্যে আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে এই শব্দগুলো। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে স্বস্তি না পাওয়ায় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে।

সরকারি তথ্য বলছে, ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে দেশে মূল্যস্ফীতি উচ্চতর পর্যায়ে আছে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে এটি নয় শতাংশেরও বেশি।

সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রতিশ্রুতি ও অভিযানের পরও পবিত্র রমজানেও ক্রেতারা নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে রেহাই পাননি। নিত্যপ্যণের বাড়তি দাম তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে দিয়েছে।

যেমন, ছোলার কথাই ধরা যাক।

আমদানি করা বেশিরভাগ ডালজাতীয় পণ্যের দাম গত দুই মাসে সাড়ে ১৩ শতাংশ ও রোজার মাসের প্রথম নয় দিনে সাড়ে ২৩ শতাংশ বেড়েছে।

ইফতারের আরেক জনপ্রিয় উপকরণ খেজুরের দামও বেড়েছে। জিলাপির প্রধান উপকরণ চিনির দাম স্থির আছে। ভোজ্যতেল কেনার সময় ক্রেতারা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। আমদানি করা ফলের দামও কিছুটা কমেছে।

কিন্তু চাল, মুগ ও অন্যান্য ডাল এবং ব্রয়লার মুরগির দাম এখনো কমেনি।

দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সত্ত্বেও নিত্যপণ্যগুলো আরও দামি হয়ে উঠেছে। সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে আমদানি কর ও ভ্যাট কমিয়েছে। মজুতদারির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে। সরকার খোলা বাজারে বিক্রি আবার চালুর পাশাপাশি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে।

প্রশ্ন উঠছে, বাজারের কী অবস্থা? কেন পণ্যের দাম কমছে না?

বাজারের এমন পরিস্থিতি কেন তা জানতে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন, শিল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।

একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ হলো—সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে পার্থক্য। অর্থাৎ চাহিদার যথাযথ মূল্যায়ন ও সক্রিয় পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হবে না।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি খোলার সময় ডলার কিনতে ব্যাংকগুলোকে অনানুষ্ঠানিকভাবে অর্থ দেয়।

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এমএ তসলিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার যেভাবে পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিতে পারে এবং দামও বেঁধে দিতে পারে। তবে বাজারের নিজস্ব ধরন আছে। সরকারের তথ্য সঠিক হলে বর্তমান পরিস্থিতিই তৈরি হতো না।'

তিনি মনে করেন, সরবরাহে ঘাটতি থাকায় পণ্যের দাম বেড়েছে।

তবে রমজানে চাহিদা বাড়বে জেনেও ব্যবসায়ীরা কেন সরবরাহ বাড়াচ্ছেন না, তা তার কাছে বোধগম্য নয়।

'ব্যবসায়ীরা জানেন ভালো মুনাফা হতে পারে। তারপরও তারা বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে পণ্য সরবরাহ করছেন না। বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে তদন্ত প্রয়োজন,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি সরকারকে চাহিদা ও সরবরাহের সঠিক তথ্য দেওয়ার জন্য নিরপেক্ষ সংস্থা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ডেইলি স্টারকে বলছেন, 'সরকারের মূল্য নির্ধারণ মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরবরাহ ও চাহিদার ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ করা হয়।'

দাম ধরে দেওয়ার মূলে কাজ করা তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'তথ্য ও পদ্ধতি বাস্তবসম্মত হলে মূল্য নির্ধারণ কার্যকর হয়।'

'শুধু দাম বেঁধে দিলেই সরকারের কাজ শেষ হয়ে যায় না। সেই দাম যেন মানা হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এটি সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে।'

দামের লাগাম টানতে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো লাখ লাখ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে কিনা সে বিষয়ে তার সন্দেহ আছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান দাবি করেন, নিয়মিত অভিযানের ফলে কয়েকটি পণ্যের দাম কমেছে।

তিনি বলেন, 'ডলার ও বেশি শুল্কের কারণে আমদানি খরচ বেড়েছে।'

শুধু এই দুই কারণে পণ্যের দাম বাড়তে পারে না।

এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, 'পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীদের বেশি লাভ করার প্রবণতাও আরেকটি কারণ হতে পারে।'

দেশের অন্যতম বৃহৎ পণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তসলিম শাহরিয়ার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকার পরও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি পণ্যের দাম স্বাভাবিকভাবে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। পরিবহন ও শ্রমিক খরচসহ অন্যান্য খরচ আছে।'

তিনি আরও বলেন, 'বর্তমানে ক্রেতারা গত বছরের তুলনায় কম দামে ভোজ্যতেল কিনতে পারছেন। ২০২৩ সালে সয়াবিন তেলের দাম ছিল লিটার প্রতি ২০৫ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৫৭ টাকায়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে।'

তার মতে, যেহেতু বিশ্ববাজারে চিনির দাম বেশি তাই ক্রেতাদের বেশি টাকা দিতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, 'কম টাকায় ডলার ও আমদানি শুল্ক কমানোয় সয়াবিন ও চিনির দাম কমানো সম্ভব হয়েছে।'

একাধিক ব্যবসায়ীর দাবি—এলসি জটিলতার সুযোগ নিয়ে অনেকে কর ফাঁকি দিতে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে আমদানি খরচ কম দেখাচ্ছেন।

তারা বলেছেন যে খেজুর, ছোলা, মটরশুঁটি ও মসুর ডালের মতো পণ্য কেনার সময় প্রকৃত আমদানি খরচের মাত্র অর্ধেক দেখানো হচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এফবিসিবি) বেঁধে দেওয়া ডলারের দাম কেউ মানছেন না।'

'ডলারের দাম ১১০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও ব্যাংকগুলো ১১৮ থেকে ১২২ টাকায় এলসি খুলছে' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমদানি পণ্যের দাম নির্ধারণে ঘোষিত হার বিবেচনায় নেওয়া হয়।'

তার মতে, এলসি খোলার সময় কম দাম দেখানোর কারণে আসল দাম জানা যায় না। যে ২৯ পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে এর বেশিরভাগই সেই দামে বিক্রি হচ্ছে না।

চট্টগ্রামভিত্তিক পণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ বাড়লে ক্রেতারা কম দামে পণ্য কিনতে পারবেন।'

তিনি আরও বলেন, 'ব্যাংকগুলোর সঙ্গে গ্রাহকের সম্পর্কই বলে দেয় তারা এলসি খোলার সুযোগ পাবেন কিনা।'

ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাড়তি মুনাফার প্রবণতা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'এর মানে সব ব্যবসায়ীর জন্য সমান ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছেই।'

সম্প্রতি, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রমজান উপলক্ষে বন্দর নগরীর বাজারগুলোয় প্রতিদিন বেশ কয়েকটি টিম অভিযান চালাচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ীকে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করতে দেখা গেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা কাস্টমস থেকে আমদানির তথ্য নিয়ে এক আমদানিকারকের গুদামে গিয়েছিলাম। বিক্রির রসিদ নিয়ে তথ্য ক্রস চেক করে দেখেছি যে আমদানি খরচের চেয়ে মুনাফা দ্বিগুণেরও বেশি ছিল।'

Comments