চিনির বাজার: সরকারি থেকে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের তথ্য অনুসারে, মেঘনা গ্রুপ সাড়ে ৪০ শতাংশ ও সিটি গ্রুপ সাড়ে ২৮ শতাংশ অপরিশোধিত চিনি আমদানি করছে।
চিনির বাজার
বাজারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ চিনির স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখলেও আমদানি নির্ভরতা নিয়ে ঝুঁকি আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ছবি: সংগৃহীত

প্রায় দুই দশক আগেও দেশের চিনি শিল্পে ১৫ রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার আধিপত্য থাকলেও এখন তা পাঁচ বেসরকারি কারখানার নিয়ন্ত্রণে।

তারপরও ২০২৩ সালে আমদানি করা ১৭ লাখ টন অপরিশোধিত চিনির প্রায় ৭০ শতাংশই ছিল দুই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই) ও সিটি গ্রুপের দখলে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের তথ্য অনুসারে, মেঘনা গ্রুপ সাড়ে ৪০ শতাংশ ও সিটি গ্রুপ সাড়ে ২৮ শতাংশ অপরিশোধিত চিনি আমদানি করছে।

চিনির তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক ছিল এস আলম গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালে দেশের চিনির চাহিদার প্রায় পাঁচ ভাগের একভাগ মিটিয়েছিল।

ওই বছর অবশিষ্ট অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছিল অন্য দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড ও দেশবন্ধু সুগার মিলস।

ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পরিশোধন সক্ষমতা বাড়ানোয় গত অর্থবছরে দেশের নয় হাজার কোটি টাকার বেশি দামের চিনির বাজারে এখন এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য চলছে।

অন্যদিকে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সব চিনিকল পরিচালনাকারী সংস্থা বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) ধীরে ধীরে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।

মূলত দেশে আখ চাষ কমে যাওয়া এটি হয়েছিল। অনেকের আশঙ্কা আমদানি-নির্ভর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য ক্রেতাদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।

বর্তমানে পাঁচ বেসরকারি চিনিকল দেশের ২০ লাখ টন পরিশোধিত চিনির বার্ষিক চাহিদার ৯৮ শতাংশেরও বেশি পূরণ করে। এর বেশিরভাগই আসে ব্রাজিল থেকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৩ সালে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব শোধনাগার স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার পর চিনির বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য হারিয়েছে সরকার

আগে, বিএসএফআইসির শোধনাগারগুলো সারা দেশে ডিলারদের মাধ্যমে খেত থেকে আখ সংগ্রহ করতো।

বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল হাশেম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সে সময় দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ছিল দুই থেকে তিন লাখ টন। তাই বিএসএফআইসির পক্ষে বাজার স্থিতিশীল রাখা সহজ ছিল।'

তবে আখ চাষ কমে যাওয়ায় ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে শেষ পর্যন্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাজারে আসার অনুমতি দিতে বাধ্য হয় সরকার।

গত তিন দশক ধরে চিনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আবুল হাশেম আরও বলেন, 'পরে ধীরে ধীরে পুরো বাজার পাঁচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যায়।'

দেশের অন্যতম বৃহৎ পণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ ২০০৬ সালে চিনি পরিশোধন শুরু করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক প্রায় পাঁচ হাজার টন চিনি উৎপাদন করে।

মেঘনা গ্রুপ একই বছর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড সুগার মিলসের মাধ্যমে চিনি পরিশোধন শুরু করে। দৈনিক প্রায় ৯০০ টন উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে কারখানা শুরু হয়েছিল। এখন উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার টন।

মেঘনা গ্রুপ ও সিটি গ্রুপের কর্মকর্তারা ডেইলি স্টারকে জানান, তারা ক্রমান্বয়ে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াচ্ছেন। ২০১৮ সালে এই প্রতিষ্ঠান দুটি সম্মিলিতভাবে চিনির বাজারের ৩৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতো।

রাষ্ট্র পরিচালিত কারখানাগুলোয় উত্পাদন ক্রমাগত কমতে থাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোয় উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ২৫ হাজার টনে। ২০০১-০২ অর্থবছরে তা ছিল দুই লাখ টন।

লোকসান কমাতে বিএসএফআইসি ২০২০ সালে তাদের ছয় চিনিকল বন্ধ করে দেয়।

একটি বেসরকারি শোধনাগারের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আখ চাষের জন্য জমির অভাব রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোয় উৎপাদন কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।'

বাজারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ চিনির স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখলেও আমদানি নির্ভরতা নিয়ে ঝুঁকি আছে।

বর্তমানে ভারত চিনি রপ্তানি নিষিদ্ধ করায় দেশের কারখানাগুলো মূলত ব্রাজিল থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করছে।

মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তসলিম শাহরিয়ার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একটি দেশের ওপর নির্ভরতা চিনির দামে অস্থিরতার ঝুঁকি তৈরি করছে।'

তিনি আরও বলেন, 'যেসব প্রতিষ্ঠান নানান পণ্যের ব্যবসা করে তারা ধাক্কা সহ্য করতে পারে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠান শুধু চিনি পরিশোধন ও বিক্রি করলে তা টেকসই হবে না।'

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, খুব কম প্রতিষ্ঠান অধিকাংশ পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।'

তার মতে, 'রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা একটি সমাধান হতে পারে। কিন্তু, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও ধীরগতির ঝুঁকি আছে।'

Comments