৪ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কারসাজির তদন্তে সাকিব আল হাসানের নাম
শেয়ারবাজার কারসাজির বিষয়ে সরকারি তদন্তে নাম আসায় আবার আলোচনায় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, কারসাজির সময় সাকিব আল হাসান ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বেশ কয়েকবার 'বিপুল সংখ্যক শেয়ার' লেনদেন করেন।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত বছরের ৫ মে থেকে চলতি বছরের ১০ মার্চ পর্যন্ত ৪টি তদন্ত চালায়।
বিএসইসির তদন্তে গত ২ বছরে কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের দাম হেরফের করার জন্য মোনার্ক হোল্ডিংসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়েছে। মোনার্ক হোল্ডিংস ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর ব্রোকারেজ হাউস হিসেবে যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সাকিব আল হাসান।
এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিয়া হাসান, তার স্বামী আবুল খায়ের ও তাদের কয়েকজন আত্মীয়কে ৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বিএসইসি।
নিয়ম লঙ্ঘন করে ফরচুন সুজ, বিডিকম অনলাইন, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য 'সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের' মাধ্যমে বাড়ানোর জন্য তাদের এ জরিমানা করা হয়েছে।
নিজেদের মধ্যে লেনদেন করে কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ানোকে স্টক এক্সচেঞ্জের ভাষায় 'সিরিয়াল ট্রেডিং' বলা হয়। এভাবে শেয়ারের মূল্য প্রভাবিত করা আইনত নিষিদ্ধ।
শেয়ারের এই কারসাজির সময় ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাকিবের নাম উঠে আসে। বিএসইসি অবশ্য তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেনি।
বিএসইসির তদন্তে বলা হয়, আবুল খায়ের গত বছরের ২০ মে থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত তার সহযোগীদের মধ্যে শেয়ার বেচাকেনা করে ফরচুন সুজের শেয়ারের মূল্যকে প্রভাবিত করেন। এতে ২০ দিনে ফরচুনের শেয়ারের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়।
ওই সময় ফরচুনের শেয়ারের শীর্ষ ক্রেতাদের মধ্যে সাকিবের নাম ছিল। তিনি তার বিও অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩৫ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার কিনেছিলেন এবং একই সময়ে ৩ লাখ ৮৩ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছিলেন।
বিএসইসির ৪ তদন্তের মধ্যে একটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ক্রিকেটের এই অলরাউন্ডার এর আগেও বেশ কয়েকবার বিতর্কিত হয়েছিলেন। এক জুয়াড়ির দেওয়া প্রলোভনের বিষয়টি না জানানোয় ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) তাকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল।
এ বছরের আগস্টে বেটিং সাইট বেটউইনারের একটি সহযোগী সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হন সাকিব আল হাসান। সে সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চাপে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন।
গত বছরের ১৫-৩০ নভেম্বর আবুল খায়ের ও তার সহযোগীরা 'সিরিয়াল ট্রেডিং' করে শেয়ারের দাম প্রভাবিত করার সময় সাকিব ওয়ান ব্যাংকের ৭৫ লাখ শেয়ার কিনেছিলেন এবং এর মধ্যে ১০ লাখ ২০ হাজার শেয়ার বিক্রি করেছিলেন।
ওই ১৫ দিনে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দাম বেড়ে যায় ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
বিএসইসির আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ৫-২৪ মে পর্যন্ত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১৭২ শতাংশ বেড়েছিল। সাকিব ওই ব্যাংকের ২৭ লাখ শেয়ার কিনেছিলেন এবং ১ লাখ শেয়ার বিক্রি করেছিলেন।
ডিআইটি কো-অপারেটিভ এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য কারসাজিতে ভূমিকা রেখেছিল। আবুল খায়ের ডিআইটি কো-অপারেটিভের চেয়ারম্যান।
বিডিকম অনলাইনের শেয়ারের মূল্য কারসাজির মূল হোতা ডিআইটি কো-অপারেটিভ বলে উল্লেখ করেছে বিএসইসি।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৭ মার্চ থেকে মাত্র ৪ দিনে বিডিকম অনলাইনের শেয়ারের দাম ৪৫ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।
বিডিকম অনলাইনের ২৫ লাখ শেয়ার কিনে সাকিবের মোনার্ক হোল্ডিংস ছিল এর পঞ্চম শীর্ষ ক্রেতা।
মোনার্ক হোল্ডিংস ওই ৪ দিনে ৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা 'আনরিয়েলাইজড গেইন' করে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বাড়ার পরও শেয়ারহোল্ডার যখন তা বিক্রি না করে রেখে দেয়, তখন ওই শেয়ারের বর্ধিত মূল্যকে 'আনরিয়েলাইজড গেইন' বলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএসইসির সাবেক এক চেয়ারম্যান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লেনদেনের ধরন দেখে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে শেয়ারের দাম প্রভাবিত করতে যখন "সিরিয়াল ট্রেডিং" চলছিল, তখন সাকিব বড় আকারের শেয়ার লেনদেন করেন।'
এভাবে ৪ বার কারসাজির সময় সাকিবের শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত 'স্বাভাবিক নয়' বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিএসইসির ওই সাবেক চেয়ারম্যান আরও বলেন, 'কাকতালীয়ভাবে ৪ বার একই ঘটনা ঘটে না।'
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে বারবার চেষ্টা করেও সাকিবের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। গত মঙ্গলবার রাত ১১টা থেকে বুধবার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ৬ বার ফোন করলেও, সাকিবের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
তার মোবাইল ফোনে ও মেসেঞ্জারে টেক্সট মেসেজ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি এর জবাব দেননি।
বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়তো সাকিব নেননি। এমন হতে পারে যে সাকিব অন্যদের (শেয়ার কেনাবেচার জন্য) পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন। তিনি হয়তো বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতেন না।'
সাকিবের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে রেজাউল করিম অস্পষ্টভাবে উত্তর দেন।
তিনি বলেন, 'লেনদেনের ধরন, বিনিয়োগকারীদের বক্তব্য ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বিএসইসি ব্যবস্থা নেয়। প্রতিবেদনে যাদের নাম আসবে, তাদের সবার জন্য একই ধরনের শাস্তি প্রযোজ্য হয় না।'
Comments