শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ অর্ধেকে নেমেছে, কাজে আসেনি রোড-শো

ফ্লোর প্রাইস, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিএসইসি, শেয়ার ব্যবসা,
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। ফাইল ফটো

আস্থা সংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও ফ্লোর প্রাইস চালুর কারণে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশি কোম্পানি ও ব্যক্তিদের বিনিয়োগ ২০ দশমিক ৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যা ছিল ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।

গেল অর্থবছরে যে বিনিয়োগ হয়েছে এর মধ্যে ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার এসেছে বিভিন্ন বন্ডে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, 'মূলত সুশাসনের অভাব, টাকার অবমূল্যায়ন ও ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা চালুর কারণে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে।'

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বেশ কয়েকটি রোড-শো করলেও তা কাজে আসেনি।

আল-আমিন বলেন, রোড-শোর মাধ্যমে বিএসইসি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে। কিন্তু, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে ঢুকলেই দেখছে যে দুর্বল মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পনিগুলো এখানের শেয়ারবাজারে আধিপত্য বিস্তার করে।

'এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে সুশাসনের অভাব আছে। ফলে তারা বিনিয়োগে আগ্রহ পান না,' বলেন তিনি।

এছাড়া ফ্লোর প্রাইস বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

২০২২ সালের জুলাইয়ে করোনা মহামারিতে বিশ্বব্যাপী তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে সূচকের অবাধ পতন ঠেকাতে প্রতিটি শেয়ারের জন্য ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করেছিল বিএসইসি।

তবে, গত বছরের ডিসেম্বরে বাজার লেনদেনমুখী করতে ১৬৯টি প্রতিষ্ঠানের জন্য এই ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু, চলতি বছরের মার্চে আবারও সব স্টকের জন্য ফ্লোর প্রাইস চালু করা হয়।

এতে বেশিরভাগ স্টকের লেনদেন না হওয়ায় ফ্লোর প্রাইস বাজারকে স্থবির করে তুলেছে।

হিসাববিজ্ঞানের এই শিক্ষক বলেন, 'বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ ধরনের বাজার পছন্দ করেন না যেখানে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগ আটকে যেতে পারে।'

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় গত অর্থবছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের দৈনিক গড় টার্নওভার ৪০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৭৯২ কোটি টাকায়। আগের বছর যা ছিল ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা।

এদিকে গত ১৮ মাসে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ৩০ শতাংশ কমেছে, যা ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বড় ধাক্কা।

তিনি বলন, 'টাকার অবমূল্যায়নের কারণে শেয়ারের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও তাদের সম্পদের মূল্য কমেছে। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করছেন।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম প্রায় ১৬ শতাংশ কমে ১ ডলার ১০৮ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় বিএসইসি ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আটটি দেশের ১৫টি শহরে রোড-শোর আয়োজন করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্রোকারেজ ফার্মের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'রোড শো করা বিএসইসির দায়িত্ব নয়। বরং বাজারে সুশাসন নিশ্চিত করা ও কারসাজি নির্মূল করাই তাদের দায়িত্ব।'

তিনি আরও বলেন, 'কিন্তু তারা সঠিকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে বাজারে ব্যাপক হারে কারসাজি ছড়িয়ে পড়েছে।'

এই ব্রোকার মূলত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রৈ শেয়ারবাজারের কিছু দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার কথা নানা সময়ে বিএসইসির কাছে তুলে ধরলেও তার কোনো সুরাহা হয়নি।

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির সংখ্যা কম, তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করতে চান না। আবার বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক বিবরণীকে ভরসা করতে পারেন না।'

ওই ব্রোকার বলেন, তালিকাভুক্ত কোম্পানি সম্পর্কিত নীতিমালা সরকার ঘন ঘন পরিবর্তন করে, যা শেষ পর্যন্ত ফার্ম ও বিনিয়োগকারীদের মুনাফায় প্রভাব ফেলে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, মান উন্নত করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ২০২২ সালের জুনে দেশের বৃহত্তম তালিকাভুক্ত কোম্পানি গ্রামীণফোনকে সিম বিক্রি থেকে নিষিদ্ধ করে। পরে চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।

তিনি বলেন, 'বিএসইসি শুধু রোডশো করে বললেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাজারে বিনিয়োগ নিয়ে চলে আসবে না। বরং তাদেরকে বিনিয়োগে আনতে বিনিয়োগকারীরা যেসব সমস্যার কথা বলেন, সেগুলোর সমাধান করতে হবে।'

'সরকার যদি সমস্যার সমাধান করতে পারে ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে বিএসইসিকে বিনিয়োগকারীদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে না, তারা নিজেদের স্বার্থে বিনিয়োগ করতে আসবেন,' বলেন তিনি।

তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃত্রিম উপায়ে বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে টাকাকে শক্তিশালী রেখেছে। কিন্তু, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তন করা, যেন বিনিয়োগকারীদের কোনো মুদ্রার পরিবর্তন নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে না হয়।

 

Comments

The Daily Star  | English

Advisory council clears anti-terrorism law amendement

Draft includes provision to ban an entity's activities, restrict terrorism-related content online

58m ago