বিনয়ী ববিতা

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নায়িকা ববিতা। তিন শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। সোনালি যুগের সাড়া জাগানো বহু সিনেমা তার ক্যারিয়ারে যুক্ত হয়েছে। বহুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। আরও পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্রে আজীবন সম্মাননা। কলকাতা থেকেও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
সাড়া জাগানো এই নায়িকার বাসায় এক রাতে তুমুল আড্ডা বসেছিল। সেই স্মৃতি শেয়ার করছি পাঠকদের সঙ্গে।
১৪ বছর আগের এক বিকেলে হঠাৎই ববিতা আপার ফোন এলো। বললেন, 'সাজু বলছেন?'
আমি তো অবাক! কেননা, তখনো তার সঙ্গে অতটা ঘনিষ্ঠতা হয়নি।
বললেন, 'আসছে শনিবার সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসতে হবে। আমরা একসঙ্গে আড্ডা দেবো।'
ঘণ্টাখানের পর নির্মাতা আরিফ খান ফোন করে বললেন, 'ববিতা আপাকে তোমার নম্বর দিয়েছি। উনার বাসায় একটা নিমন্ত্রণ আছে, যেও প্লিজ। নিশ্চয়ই তিনি ফোন করেছিলেন।'
আমি বললাম, হ্যাঁ, ববিতা আপা ফোন করেছিলেন।
তারপর সেই শনিবার সন্ধ্যায় পৌঁছে ববিতা আপার গুলশানের বাসায়। বাসায় ঢুকে ড্রয়িং রুমেই দেখতে পাই, দেয়ালে সত্যজিৎ রায়ের ছবি টাঙানো। আরও আছে উনার নিজের করা সোনালি দিনের বিভিন্ন সিনেমার ছবি। গোছানো ও পরিপাটি ড্রয়িং রুম। একপাশে ফুল রাখা, সৌরভ ছড়াচ্ছে। আমি দেয়ালে থাকা ছবিগুলো দেখছি।
একটু পর সাংবাদিক মাহফুজুর রহমান এলেন। আরও একটু পর এলেন নিপু বড়ুয়া। খ্যাতিমান সাংবাদিক আহমেদ জামান চৌধুরী তখন বেঁচে ছিলেন, যিনি নায়ক রাজ্জাককে 'নায়করাজ' উপাধি দিয়েছেন। তিনিও এসে পৌঁছালেন কিছুক্ষণ পর। এক এক করে সাত থেকে আটজন গণমাধ্যমকর্মী এসে বসলেন। আহমেদ জামান চৌধুরীকে পেয়ে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করল।
আমরা সবাই অপেক্ষা করছি ববিতা আপার জন্য। নীল রংয়ের পোশাক পরে হাসিমুখে ঢুকলেন তিনি। আহমেদ জামান চৌধুরীকে সালাম দিলেন। তারপর পরিচিত হলেন আমাদের সবার সঙ্গে।
আমার নাম শুনে বললেন, 'আপনাকে ফোন করেছিলাম। খুব খুশি হয়েছি এসেছেন।'
সবিনয়ে বললাম, আপা, আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হবো।
বললেন, 'ওই হলো, আপনি যা, তুমিও তা।'

এত সাড়া জাগানো ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন নায়িকা যেভাবে সবার খোঁজ নিচ্ছেন, এতটা বিনয় নিয়ে কথা বলছেন, তা দেখে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি। তার কথা যেমন শুনছি, তেমনি তাকে দেখছিও।
সময় যেতে লাগল। নানারকম খাবার আসছে। ববিতা আপা নিজেই সব তদারকি করছেন।
বললেন, 'প্লিজ কেউ সংকোচ করবেন না। সব আপনাদের জন্যই। আজ মন খুলে আড্ডা দেবো। অনেকদিন বসা হয় না আপনাদের সঙ্গে।'
আহমেদ জামান চৌধুরীর কাছে গিয়ে বললেন, 'জামান ভাই কম খাচ্ছেন কেন?' তিনি হেসে বললেন, 'এখন ওদের সময়। আমার তো বয়স হয়েছে।' আমরাও হাসলাম।
কথায় কথায় ববিতা বললেন, 'আমার ক্যারিয়ারে সাংবাদিকদের ভূমিকা অনেক। শুরু থেকে সবার সমর্থন পেয়েছি। এখনো পাচ্ছি। কেউ কেউ তো এখন দুনিয়ায় নেই। কিন্তু সবার কথা মনে পড়ে।'
আহমেদ জামান চৌধুরী বললেন, 'তুমিও কিন্তু ঢালিউডকে অনেক কিছু দিয়েছ। তোমারও অবদান আছে। ঢাকাই সিনেমার ইতিহাস লিখতে গেলে তোমার নাম আসবেই।'
ববিতা বললেন, 'আপনাদের জন্যই আজকের আমি।'
আমরা কয়েকজন তরুণ সাংবাদিক প্রশ্ন করলাম, 'সিনেমায় এখন কম কেন আপনি?'
বললেন, 'অনেক তো করেছি। এখন নতুনরা করুক। তা ছাড়া, বয়সের সঙ্গে মিলিয়ে চরিত্র তো পেতে হবে। তাহলেই কাজ করা সম্ভব।'
খাবার শেষে ববিতা বললেন, 'আপনাদের একটি বিশেষ কারণে আজ ডেকেছি। প্রথমত আড্ডা দেওয়ার জন্য। দ্বিতীয়ত শিশুদের জন্য কিছু করতে চাই। এই বিষয়ে আপনাদের মতামত নেব।'
রূপালি পর্দার সফল নায়িকা তিনি। পেয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়তা। এখন ভাবছেন ছিন্নমূল শিশুদের কথা। তাদের জন্য কিছু করতে চান। সেই মহৎ কাজটির কথা জানাতে চান সবাইকে, সবার পরামর্শ নিতে চান। ভালো লাগলো তার উদ্যোগ দেখে।
গল্প করতে করতে একসময় বললেন, 'আমি কিন্তু ছাদ-বাগানও করি। আরেকদিন দেখাব সবাইকে।'
রাত বাড়ল। যেতে হবে। আমাদের বিদায় দেওয়ার জন্য তিনি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। লিফটে ওঠার পর তিনি বিদায় নিলেন। এই সময় আহমেদ জামান চৌধুরী বললেন, 'ভালো থেকো। তোমার বিনয় আমাদের আকৃষ্ট করে '
তার বাসা থেকে বের হয়ে ভাবতে লাগলাম, গোলাপি এখন ট্রেনে, নয়নমণিসহ অনেক সাড়া জাগানো নায়িকার মধ্যে কত বিনয়! এই স্মৃতি মনে থাকবে অনেকদিন।
৩০ জুলাই ববিতার জন্মদিন। কিংবদন্তি এই নায়িকার জন্মদিনে তার জন্য অসংখ্য শুভেচ্ছা। রূপালি পর্দার তুমুল জনপ্রিয়, অথচ বাস্তব জীবনে অতি বিনয়ী এই মানুষটির প্রতি ভালোবাসা-শ্রদ্ধা।
Comments