মানুষের গল্প, ইতিহাসের গল্প: রুপালি পর্দায় অমর ১০ বায়োপিক

বিশ্বকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন বা মানবতাকে বাঁচানোর তীব্র চেষ্টা কিংবা যুদ্ধ-রাজনৈতিক সংঘাত-দ্বন্দ্ব ও নৈতিকতার লড়াইয়ে টিকে থাকার অদম্য বাস্তব কাহিনী জীবন্ত হয়ে ওঠে বায়োপিক মুভিতে।
ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়া সত্যিকারের মহানায়কদের জীবনের যাত্রাপথের গল্প নিয়েই তৈরি হয় বায়োগ্রাফিক্যাল ড্রামা মুভি, যা স্মরণ করিয়ে দেয় মানুষের অদম্য শক্তিকে, অনুপ্রেরণা দেয় নতুন প্রজন্মকে।
বিজ্ঞান, রাজনীতি, যুদ্ধ, খেলাধুলা, সংগীতসহ নানা ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী বা ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নিয়ে এ পর্যন্ত অসংখ্য বায়োপিক নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে আইএমডিবি রেটিংসহ সমালোচকদের দৃষ্টিতে বিশ্বসেরা কয়েকটি বায়োপিকের তথ্য তুলে ধরা হলো এই লেখায়।
'শিন্ডলার্স লিস্ট' (১৯৯৩)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। হিটলারের নাজিবাহিনী পোল্যান্ড দখলের পর শুরু করে নারকীয় ইহুদী হত্যাযজ্ঞ। সে সময় মানুষকে বাঁচানোর অদ্ভুত নেশা পেয়ে বসেছিল অস্কার শিন্ডলারের।
জার্মান হওয়া সত্ত্বেও এমন নিষ্ঠুর হত্যা মেনে নিতে পারছিলেন না ধনকুবের ব্যবসায়ী অস্কার শিন্ডলার। যুদ্ধবন্দি ইহুদিদের বাঁচাতে ভিন্ন এক কৌশলের আশ্রয় নেন। নাৎসি অফিসারদের মোটা অঙ্কের অর্থ ঘুষ দিয়ে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরিয়ে আনেন ১১০০ ইহুদিকে। তার এই তালিকাই 'শিন্ডলার্স লিস্ট'।
স্টিফেন স্পিলবার্গ পরিচালিত এই সিনেমা শুধু ইতিহাসের দলিল নয়, মানবিকতার অসাধারণ দৃষ্টান্ত। ভোগবিলাসে ডুবে থাকা, মুনাফালোভী একজন ব্যবসায়ীর মানুষ হয়ে ওঠার গল্প।
সত্য কাহিনীর ভিত্তিতে নির্মিত ক্লাসিক ঘরানার মুভিটি মুক্তি পায় ১৯৯৩ সালে। জিতে নেয় সেরা পরিচালকসহ ৭টি বিভাগে অস্কার। মূল চরিত্রে অভিনয় করেন লিয়াম নেসন।
ওপেনহেইমার (২০২৩)

বিশ্ববাসী প্রথম পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা দেখে পদার্থবিদ জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহেইমারের হাত ধরে। ওই ঘটনায় নিজেও বিস্মিত হন এ বিজ্ঞানী।
ভয়ংকর এ আবিষ্কারের নেতৃত্ব দেওয়া বিজ্ঞানীর নৈতিক সংকট, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক চাপ তুলে ধরা হয়েছে 'ওপেনহেইমার' সিনেমাটিতে।
বিশ্বখ্যাত পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান নির্মিত এ সিনেমায় ওপেনহেইমার চরিত্রে অভিনয় করেন সিলিয়ান মারফি। মুভিটি শুধু বিজ্ঞান নয়, বরং নৈতিকতা, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন তোলে। দেখানো হয় কীভাবে একজন বিজ্ঞানী তার আবিষ্কারের জন্য একইসঙ্গে বীর ও অপরাধী হয়ে যান।
অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড (২০০১)

'একজন মানুষের বুদ্ধিমত্তার চেয়ে বেশি মূল্যবান তার সুন্দর হৃদয়' — অসাধারণ মেধাবী গণিতবিদ জন ন্যাশের এমন গভীর উপলব্ধি সিনেমাটি অন্তর্নিহিত অর্থ স্পষ্ট করে।
রন হাওয়ার্ডের চমৎকার বায়োগ্রাফিক্যাল ড্রামা 'অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড' গণিতবিদ জন ন্যাশের জীবনের নিয়ে নির্মিত। সিজোফ্রেনিয়ার রোগী ছিলেন ন্যাশ। সিনেমায় তার মানসিক দ্বন্দ্ব, পারিবারিক সম্পর্ক ও বিজ্ঞানী হিসেবে সাফল্য তুলে ধরা হয়। তার গেম থিওরি-ভিত্তিক গবেষণা অর্থনীতিতে বিপ্লব আনে, যার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান।
মুভির মূল চরিত্রে অভিনয় করেন রাসেল ক্রো। সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা চিত্রনাট্যসহ ৪ ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতে নেয় 'অ্যা বিউটিফুল মাইন্ড'।
দ্য থিওরি অব এভ্রিথিং (২০১৪)

কেমব্রিজের বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংয়ের জীবনের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত বিজ্ঞান ও প্রেমের বায়োগ্রাফিক্যাল ড্রামা 'দ্য থিওরি অব এভ্রিথিং'।
মাত্র ২১ বছর বয়সে মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হকিংয়ের রোগের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই, জীবনের উত্থান ও প্রেম-সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে সিনেমাটিতে।
মুভিটি শুধু একজন বিজ্ঞানীর গল্প নয়, ভালোবাসা, সংগ্রাম, ও মানবিক শক্তির এক অনন্য উপাখ্যান।
হকিংয়ের স্ত্রী জেন রচিত স্মৃতিকথা 'ট্রাভেলিং টু ইনফিনিটি: মাই লাইফ উইথ স্টিভেন' অবলম্বনে সিনেমাটি পরিচালনা করেন জেমস মার্শ। ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমায় স্টিভেন হকিংয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন এডি রেডমেইন ও তার স্ত্রী জেন হকিং চরিত্রে অভিনয় করেন ফেলিসিটি জোন্স।
বোহেমিয়ান র্যাপসোডি (২০১৮)

১৯৮৫ সালে 'লাইভ এইড' কনসার্টে 'বোহেমিয়ান র্যাপসোডি' শিরোনামে গানটি পরিবেশন করেন ব্রিটিশ রকব্যান্ড 'কুইন'খ্যাত ফ্রেডি মার্কারি। তখনো তিনি জানতেন না তার জীবনের বিদায় ঘণ্টা বেজে গেছে। মৃত্যুর আগে জীবনের সেরা পারফরম্যান্স ছিল এটি।
২০১৮ সালে ব্রায়ান সিংগার পরিচালিত 'বোহেমিয়ান র্যাপসোডি' সিনেমাটি একদিকে সফল শিল্পী ফ্রেডির সেরা সৃষ্টি আর অন্যদিকে গায়ক পরিচয়ের আড়ালে ঢাকা পড়া পথ হারানো ভবঘুরের বিষাদময় জীবনের কাহিনী।
সিনেমাটি শুধু সঙ্গীতশিল্পীর গল্প নয়, বরং স্বত্বা, বন্ধুত্ব, ক্ষমা ও ভালোবাসার অনন্য উপাখ্যান, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ আয় করা মিউজিক বায়োপিক। প্রায় ৯০২ মিলিয়ন ডলার আয় করা এ সিনেমায় ফ্রেডির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মিশরীয় বংশোদ্ভুত মার্কিন অভিনেতা রামি মালেক।
রে (২০০৪)

'রে' সিনেমাটিও বিশ্বসেরা একটি বায়োগ্রাফিক্যাল মিউজিক্যাল ড্রামা। একজন অন্ধ শিল্পীর বিশ্ব জয় করার অনুপ্রেরণাদায়ী গল্প। ছোটবেলায় দৃষ্টিশক্তি হারানো রে চার্লস দারিদ্র্য ও বৈষম্যের মধ্যে বেড়ে উঠলেও পিয়ানো বাজানোর অসাধারণ প্রতিভা তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়।
'রে' সিনেমাটি পরিচালনা করেন টেইলর হ্যাকফোর্ড। রে চরিত্রে অভিনয় করে জেমি ফক্স জিতে নেন অস্কার। জেমি ফক্স নিজেও গ্র্যামি পুরস্কারজয়ী সংগীতশিল্পী।
লিংকন (২০১২)

বিশ্বসেরা এই বায়োপিকটি অনেকেরই পরিচিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের দাসত্ববিরোধী যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত 'লিংকন' সিনেমাটির পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ।
সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০১২ সালে। বক্স অফিসে ২৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা এ সিনেমায় লিংকন চরিত্রে অভিনয় করেন ড্যানিয়েল ডে লুইস।
দ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক (২০১০)

বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের জনক মার্ক জাকারবার্গের জীবনী নিয়ে তৈরি দ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীর বিশ্বজয় ও প্রযুক্তির পেছনের রাজনীতির গল্প উঠে এসেছে এ সিনেমায়।
ডেভিড ফিঞ্চার নির্মিত এ সিনেমায় জাকারবার্গের চরিত্রে অভিনয় করেন জেসি ইজেনবার্গ। সেরা চিত্রনাট্যসহ তিন ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতেছে ২০১০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি।
ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান (২০০২)

লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও ও টম হ্যাংকস অভিনীত এ সিনেমাটি সত্য ঘটনার অবলম্বনে নির্মিত একটি চমৎকার থ্রিলার।
স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত এ সিনেমায় উঠে এসেছে প্রতারক ফ্র্যাংক অ্যাবাগ্নেল জুনিয়রের অপরাধকর্মের চমক। মাত্র ১৯ বছর বয়সে পাইলট, চিকিৎসক, আইনজীবীর ছদ্মবেশে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেন মিলিয়ন ডলার।
ইনটু দ্য ওয়াইল্ড (২০০৭)

সভ্যতা-আধুনিকতা ছেড়ে প্রকৃতির মাঝে এক তরুণের বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা নিয়ে ভিন্নধর্মী গল্পের সিনেমা ইনটু দ্য ওয়াইল্ড।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমায় দেখা যায়, তরুণ ক্রিস্টোফার ম্যাকক্যান্ডলেস স্নাতক শেষ করে সমাজ, ভোগবাদ ও পারিবারিক কলহ থেকে মুক্তির উদ্দেশে যাত্রা করেন। সব ছেড়ে বুনো প্রকৃতিতে তার একাকী জীবন শেষ হয় আলাস্কায়।
শন পেন পরিচালিত ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেন এমিল হির্স।
Comments