বাপীতে সওয়ার মহীনের মায়ায় ভাসল ঢাকার ‘মেরুন সন্ধ্যালোক’
বাংলার নন্দনের শক্তিশালী উপাদান 'মায়া'র দাবি নিয়ে রচনায় হাজির ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। কবিতায় তিনি যে রহস্যের মায়াজাল বিছিয়েছিলেন, গানে গানে সেটাকে উৎসারিত করার দায় নিয়েছিল সত্তরের দশকের মধ্যভাগ থেকে ছুটে চলা কলকাতার বাংলা রক ব্যান্ড 'মহীনের ঘোড়াগুলি'।
জীবনানন্দের কবিতা কিংবা মহীনের গানের মরমেই আছে মায়া। এই মায়াকে নিছক 'ইল্যুশন' কিংবা বিভ্রম বলা যাবে না; বরং তা অনেকটা হারানোকে ফিরে পাওয়ার টান, নিজের ভেতরেই আরেক নিজের খোঁজ, প্রেমের প্রগাঢ় বোধ অথবা বিচ্ছিন্নতার বেদনা চিরে যূথবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা।
গতকাল শুক্রবার কেবল গানের পথ ধরে এমন যূথবদ্ধতার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি হলো ঢাকার আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে। মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তাপস বাপী দাসের প্রয়াণে তাকে উৎসর্গ করে আয়োজিত 'ভালোবাসি জ্যোৎস্নায়' শিরোনামের কনসার্টে মহীনের গানেই গলা মেলালেন বাংলাদেশের ৩৬ শিল্পীসহ হাজারো দর্শক-শ্রোতা।
এই কনসার্টে মহীনের জীবিত কোনো সদস্য উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু তাদের সবার উপস্থিতি টের পাওয়া গেল এখানকার প্রত্যেক শিল্পীর পরিবেশনায়। আর এভাবেই অন্যের কণ্ঠে মহীনের জীবিত ও মৃত সব ঘোড়াই বাপীতে সওয়ার হয়ে তাদের সৃষ্ট কথায়-সুরে ঢাকার 'মেরুন সন্ধ্যালোক' জড়িয়ে রাখলেন প্রেম-দ্রোহ-মায়া আর ভালোলাগা-ভালোবাসার আবেশে।
প্রতিষ্ঠার ২০ বছরের মাথায় নব্বই দশকের শেষভাগে 'মায়া' নামের যে অ্যালবামটি রিলিজ করেছিল মহীনের ঘোড়াগুলি, সেটার সঙ্গে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় এই 'মায়া'র বিষয়টি স্পষ্ট করেছিলেন আদি ঘোড়ারা। সেখানে তারা বলছেন, 'যেহেতু জীবন শিল্পতেই শেষমেষ ঊষালগ্ন খুঁজে পায়, তাই শিল্পতেই আমাদের এই মায়াময়তা সাকার, অন্তর্দ্বন্দ্বহীন, বাস্তব, দৃশ্যশোভন মায়া নয়। তারও বাইরে আমাদের এই গান।'
এই লেখাতেই 'সেকাল' থেকে 'চিরকালে' যাত্রার এক 'অন্বেষণের' ঘোষণা এসেছিল 'নালহীন' এই ঘোড়াদের তরফ থেকে। তারা বলেছিলেন, 'যে অন্বেষণের মূলে আছে আমাদের গড়া কিছু গান। এতে মায়া আছে অনুক্ষণ...।'
তারা আরও বলেছিলেন, 'তিমির বিলাস কিম্বা তিমির বিনাশ। এ দুটোই যে আমাদের মনের ভেতরে স্ববিরোধে তীব্র। সৌন্দর্যের সাকার, দৃশ্য, শ্রুতি মধুরতাও আমাদের যেমনভাবে ভাবায়, তার অন্তর্লীণ শূন্যতা, আতঙ্ক, অর্থহীনতাও তেমনিভাবে আমাদের কাঁপায়।'
এই দর্শন মেনে বিশ্বসংগীতে ষাটের দশকের 'আরবান ফোক' ধারার অনুসারী 'মহীনের ঘোড়াগুলি' গতানুগতিক সংগীতবোধের বাইরে গিয়ে রাজনীতি, বৈষম্য, দারিদ্র, অর্থনীতি, অন্যায়-অবিচার, বিপ্লব, প্রেম, একাকীত্ব ও স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোকে উপজীব্য করে বাউল, রক এবং লাতিন মিউজিকের মিশেলে গানের নতুন এক জগত উপস্থাপন করতে থাকেন। এভাবে পরবর্তী ৫ দশকে ব্যান্ডটি কলকাতার পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যান্ড সংস্কৃতিতে ও অসংখ্য তরুণ গায়কের কাছেও হয়ে ওঠে অনুপ্রেরণার নাম।
ব্যান্ডটির 'ভালোবাসি জ্যোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে', 'এই সুরে বহুদূরে', 'সুধীজন শোনো', 'ভেসে আসে কলকাতা' ও 'সংবিগ্ন পাখিকূল' এর মতো গানগুলো এখনো দুই বাংলার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এ সবকটি গানের কণ্ঠ, সুরে কিংবা কথায় মিশে আছে ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাপস বাপী দাস বা বাপীদার নাম। তিনি গিটারও বাজাতেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছিলেন বাপী। এরপর থেকে হাসপাতালে তার চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু চিকিৎসা করাতে গিয়ে অর্থাভাবে সংকটে পড়ে তার পরিবার। এ সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন ঢাকায় এই ব্যান্ডের ভক্ত বাংলাদেশি শিল্পীরাও।
এর অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ১৪ জুলাই বাপীদার চিকিৎসা সহায়তার জন্য 'ভালোবাসি জ্যোৎস্নায়' শিরোনামের কনসার্ট আয়োজনের পরিকল্পনা করেন বাংলাদেশের আয়োজকরা। সে অনুসারে চলতে থাকে সব প্রস্তুতি। কিন্তু ২৫ জুন বাপীদার মৃত্যুতে শুরুতে একটা ধাক্কা আসলেও একই দিনে কনসার্টটি আয়োজনের ব্যাপারে অবিচল থাকেন তারা। জানান, বাপীদার পরিবারের পাশে দাঁড়াতেই তারা কনসার্টটি করবেন।
গতকাল বিকেল ৪টায় কনসার্ট শুরুর নির্ধারিত সময়ের আগেই আগারগাঁও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে ভিড় করতে থাকেন মহীনের ঘোড়াগুলির ভক্ত-অনুসারীরা। সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে একে একে মিলনায়তনে ঢোকেন তারা। বাইরে ছিল কনসার্ট উপলক্ষে তৈরি পোস্টার, টি-শার্ট ও বাপীদার আত্মজীবনীমূলক বই বিক্রির বন্দোবস্ত।
মঞ্চের সব প্রস্তুতি শেষে বিকেল সাড়ে ৪টায় শুরু হয় গানের পালা। প্রথমেই মঞ্চে ওঠেন আয়োজকদের তালিকার বাইরে থাকা 'অতিথি শিল্পী' আদিত্য ভৌমিক। তিনি তাপস বাপী দাসের কথায় 'এই সুরে বহুদূরে' গানটি গেয়ে শোনান। এরপর রাজশাহী থেকে আসা আরও ২ অতিথি শিল্পী সাশা ও মার্টিন শোনান 'সুধীজন শোনো' ও 'মেরুন সন্ধ্যালোক' গান দুটি।
অতিথি শিল্পীদের পরিবেশনার পর মঞ্চ মাতাতে থাকেন ঢাকার বিভিন্ন ধারার শিল্পীরা। একে একে মঞ্চে আসেন অর্ঘ্য, অন্তু দাস, আরমীন মূসা, আহনাফ খান অনিক, আহমেদ হাসান সানি, কাকতাল, জয় শাহরিয়ার, তানযীর তুহিন (আভাস), তিলক, দ্যা রেহমান ড্যুও, নাঈম মাহমুদ, প্রবর রিপন (সোনার বাংলা সার্কাস), ফারহান, ফারাহ দিবা তাসনিম, ভাষা, মাঈশা মারিয়াম, মাসুদ হাসান উজ্জ্বল, মিশু (শহরতলী), মুয়ীজ মাহফুজ, মুসা কলিম মুকুল, রাজু (সহজিয়া), রাব্বি (সহজিয়া), রায়হানুল ইসলাম শুভ্র, রাশিদ শরীফ শোয়েব (মেঘদল), রিয়াদ হাসান, রোকসানা আমিন, লাবিক কামাল গৌরব, লিমন, লিসান, সন্ধি, সভ্যতা, সালেকিন, সিনা হাসান (বাংলা ফাইভ), সুহৃদ ও শুভেন্দু দাস শুভ।
রকমারি সব বাদ্যযন্ত্রের অনুষঙ্গে মহীনের পরিচিত-অপরিচিত সব গানে-কথায় এ শিল্পীরা জানিয়ে দেন মহীনের ঘোড়াগুলির প্রতি তাদের অনুরাগের কথা। তাপস বাপী ছাড়াও উঠে আসে ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত গৌতম চট্টোপাধ্যায়, তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, এব্রাহাম মজুমদার, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় ও অরুনেন্দু দাসের মতো সব নাম।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মিলনায়তনভর্তি দর্শকের উচ্ছ্বাস জানিয়ে দেয় বাংলা সংগীত জগতে মহীনের ঘোড়াগুলির গানের প্রভাব এখনো কতটা প্রবল! বোঝা যায়, কেন সেই সত্তরের দশকে টগবগিয়ে চলা এসব ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আজও গান হয়ে বাজে শ্রোতাদের কানে!
'মহীনের ঘোড়াগুলি' নামটি নেওয়া হয়েছিল জীবনানন্দ দাশের 'ঘোড়া' শিরোনামের কবিতা থেকে। শুরুতে ব্যান্ডটির নাম ছিল 'সপ্তর্ষি'। কনসার্টে '৯ বছর পর' মঞ্চে ওঠা নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল জানালেন, তার পরবর্তী চলচ্চিত্র 'বনলতা সেন'- এ মহীনের গান থাকছে।
ব্যান্ডদল মেঘদলের রাশিদ শরীফ শোয়েব বললেন, মহীন তার কাছে 'ঈশ্বরসম'। গায়ক শুভেন্দু দাস শুভর কথায়, মহীনের ঘোড়াগুলির গান তার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য এক অনুপ্রেরণা।
মঞ্চে বাপীদাকে স্মরণ করে কনসার্টের অন্যতম আয়োজক গৌতম কে শুভ বলেন, 'বাপীদা সবসময় একটা কথা বলতেন, আজ এখানে থাকলেও হয়তো বলতেন। সেটা হলো- আমিও মহীন, তোমরাও মহীন।'
শুভ জানান, এই কনসার্টে ব্যান্ড নিয়ে বাপীদা ও তার সহধর্মিনী সুতপাদিরও আসার কথা ছিল। তিনি বলেন, 'বাপীদার বাংলাদেশের প্রতি একটা আলাদা টান ছিল। দুটো বাংলায়ও উনি বিশ্বাস করতেন না। ওনার পূর্বপুরুষরা ছিলেন বাংলাদেশে। উনি বলতেন দুটো বাংলা মিলে একটা দেশ।'
মহীনের ঘোড়াগুলির প্রধান কারিগর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাপস বাপী ২০০৩ সালে একটা ব্যান্ড করেন 'মহীন এখন ও বন্ধুরা' নামে। গতকালের কনসার্টে উপস্থিত ছিলেন এই ব্যান্ডের ২ সদস্য সুমন ও প্রমিত। মঞ্চ থেকে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মহীন অনুরাগীদের জন্য বাপীদার বক্তব্যের একটি অডিও ক্লিপ শোনান তারা।
সেখানে বাপীদাকে বলতে শোনা যায়, 'শো মাস্ট গো অন অ্যান্ড অন। আজ যারা গান গাইছেন তাদের যূথবদ্ধতাই সত্তরের দশকের মহীনের ঘোড়াগুলির সার্থকতা।'
পরে সুমন ও সৌভিক বাপীদার লেখা ও সুর করা 'ফিরে আসবে' গানটি গেয়ে শোনান।
আয়োজনের শেষ পর্যায়ে কনসার্টে অংশ নেওয়া সব শিল্পী একসঙ্গে মঞ্চে উঠে গেয়ে ওঠেন 'ভালোবাসি জ্যোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে' গানটি। এই গানের সঙ্গেও গলা মেলান মিলনায়তনভর্তি দর্শক-শ্রোতারা।
এবার আবারো ফেরা যাক 'মহীনের মায়া'র প্রসঙ্গে। 'মায়া' শিরোনামের অ্যালবামের জন্য তৈরি পুস্তিকার শুরুর কথাগুলো ছিল এ রকম- 'আজ শ্রাবণের এই শেষ ভাগে, আকাশে হঠাৎই কিছু বর্ষণক্ষান্ত আলোর নম্রতা, চারধারে সবুজের ঘন বুনোট, কিছু নীলাঞ্জন ঘন ছায়ার অবশেষ, কিছু কদমের দান, কিছু ঝরা হাওয়া। বলতেই পারা যেত, 'মায়া রহিয়া গেল'।'
ঠিক শ্রাবণ না হলেও, গতকাল শুক্রবার ছিল আষাঢ়ের শেষ দিন। কনসার্টের মাঝামাঝি সময়ে বাইরে শুরু হয় অঝর বৃষ্টি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের সবুজ ঘাস, লতা-পাতা তাতে সিক্ত হতে থাকে, ঝরা হাওয়া খেলতে থাকে বৃক্ষরাজির ডালে ডালে। কিন্তু ভেতরে বসে সেটা তো টের পাওয়ার উপায় ছিল না।
বিষয়টা বোঝা গেল কনসার্ট শেষে বাইরে আসার পর। মিলনায়তনের ভেতর প্রায় ৫ ঘণ্টা বিরতিহীন মহীনের সঙ্গ শেষে বাইরের পৃথিবীতে বেরিয়ে মেঘমেদুর পরিবেশ আর বৃষ্টিতে ভেজা প্রকৃতি দেখে মনে হয়—চরাচর যেন সত্যিই মায়ায় ভাসছে।
Comments