উলিপুরে ৪ দিনে তিস্তায় বিলীন ২৫০ বসতভিটা
আহেদা বেগম (৬০) তিস্তার তীরে বসে অঝরে কাঁদছিলেন। তার শেষ সম্বল ১০ শতাংশ জমির বসতভিটা গত বৃহস্পতিবার সকালে নদী গর্ভে চলে যায়। এর আগে নদীতে বিলীন হয় তাদের ৪ বিঘা আবাদি জমি।
ঘর সরিয়ে নিয়ে রাস্তার পাশে রাখা হয়েছে। ঘর ওঠানোর জন্য এখন এক খণ্ড জমির প্রয়োজন।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বজরা ইউনিয়নে পশ্চিম বজরা গ্রামের আহেদা বেগমের মতো করুণ অবস্থা অনেকের। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদেরকে কাটাতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে আহেদা বেগম বলেন, 'হামার আর কিছুই থাকিল না। তিস্তা হামাক শ্যাষ করে দ্যাইল। এ্যালা হামরা যে কোনটে কোনা যামো কি খামো তার কোন ঠায় ঠিহানা নাই।'
আহেদার প্রতিবেশী ৩ সন্তানের জননী মোসলেমা বেগম (৩৬) কেঁদে কেঁদে ডেইলি স্টারকে জানালেন, তাদের ৬ শতাংশের বসতভিটা তিস্তার গর্ভে চলে গেছে। সন্তানদের নিয়ে কোথায় আশ্রয় পাবেন তা জানা নেই। আপাতত ২টি ঘর ভেঙে সরকারি রাস্তার পাশে রেখেছেন।
তিনি বলেন, 'প্রত্যেক বছর বাড়ি ভাঙতে ভাঙতে হামরা শ্যাষ হয়া গ্যাইলোং। এ্যালা আর হামার যাবার জাগা নাই।'
একই গ্রামের কৃষক আতিয়ার রহমান (৫৫) কথা বলতে বলতে কেঁদে উঠেন। তার বসতভিটা আর এক বিঘা আবাদি জমি এখন তিস্তার পেটে। তিস্তায় ভাঙনের কারণে তাকে ১৫ বার বসতভিটা হারাতে হয়েছে।
এক যুগ আগেও তিনি ১০ বিঘা জমির মালিক ছিলেন। এখন নিঃস্ব-ভূমিহীন। অন্যের জমিতে ঘর তুলে তার পরিবারকে বসবাস করতে হবে। আতিয়ার রহমান, 'বসতভিটা না থাকার দুঃখ আগোত বুঝোং নাই। এ্যালা বুঝবার নাগছোং। কাইও এ্যাকনা জাগাও দিবার চাবার নাগছে না।'
পশ্চিম বজরা জামে মসজিদের ঈমাম দেলোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চোখের সামনে মসজিদটি তিস্তায় বিলীন হয়েছে। মসজিদের কোন কিছুই সরানোর সময় পাওয়া যায়নি। নদীপাড়ের মানুষ অনেক কষ্টে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।'
স্থানীয়রা ডেইলি স্টারকে জানান, বজরা ইউনিয়নের ২ দিকে তিস্তা আর এক দিকে ব্রহ্মপুত্র। প্রতিবছর বন্যা-ভাঙনে এই ইউনিয়নে বিপুল সংখ্যক পরিবারকে নিদারুণ কষ্ট করতে হয়। জমানো টাকায় ঘর সরাতে হয়। দারিদ্রের বলয় থেকে তারা বের হতে পারছেন না।
উলিপুর উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ভয়াবহ ভাঙনে পড়েছে বজরা ইউনিয়নে তিস্তাপাড়ের মানুষ। ৪ দিনে ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়েছে আড়াই শতাধিক বসতভিটা ও কয়েক শ বিঘা আবাদি জমি।
ভাঙনে বিলীন হয়েছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, ২টি মসজিদ, একটি মন্দির, একটি ঈদগাহ মাঠ, একটি দাখিল মাদ্রাসা, একটি বাজার ও একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
বজরা ইউনিয়নের পশ্চিম বজরা, কালপানি বজরা ও সাতালস্কর গ্রামে প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকায় তিস্তার ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই তিস্তায় বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, আবাদি জমি ও স্থাপনা।
উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিপুল কুমার গণমাধ্যমকে জানান, গত এক মাস ধরে বজরা ইউনিয়নে তিস্তার ভাঙন চলছে। গত ৪ দিনে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর তালিকা করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়েছে।
তালিকা প্রস্তুতের পর ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর মধ্যে সরকারি ত্রাণ সহায়তা বিতরণ করা হবে বলেও জানান ইউএনও। তিনি বলেন, 'বজরা ইউনিয়নে তিস্তার ভাঙন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে।'
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, 'বজরা ইউনিয়নে ভাঙনকবলিত গ্রামগুলোর উজানে নদী শাসনের ব্যবস্থা নেওয়ায় এখানে ভাঙন শুরু হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো করা হয়েছে।'
Comments