‘মৃত্যুর পর বাবা একবিন্দু মাটি পায়নি, এই আফসোসটা আজীবন থাকবে’

চার দিন অসুস্থ থাকার পর শুক্রবার ভোরে মারা যান আলীম উল্লাহ। তখন তার বাড়ি, গ্রাম, এমনকি ইউনিয়নের চারপাশেই অথৈ পানি।
আলীম উল্লাহ। ছবি: সংগৃহীত

যতদূর চোখ যায়, কেবলই অথৈ পানি। কোথাও নেই একবিন্দু ডাঙ্গা। গলা সমান উচ্চতার পানিতে বেঁচে থাকার প্রাণপণ লড়াই যখন চলছে, তখনও থেমে থাকে না অমোঘ সত্য 'মৃত্যু'।

বন্যার এমন ভয়াল পরিস্থিতিতেই গত ২৩ আগস্ট শুক্রবার ভোরে মৃত্যুবরণ করেন ফেনীর সাতসতী গ্রামের বাসিন্দা আলীম উল্লাহ (৭৩)। তার মৃত্যুর পর প্রায় দুইদিন কোথাও দাফনের জন্য শুকনো জায়গা পাওয়া যায়নি, এমনকি এই জরুরি পরিস্থিতিতেও কোনোভাবেই যোগাযোগ করা যায়নি জেলা শহরে।

বাধ্য হয়েই ২৪ আগস্ট বিকেলে আলীম উল্লাহর মরদেহ ভেলায় ভাসিয়ে দেন স্বজনেরা।

বন্যায় ফেনীর সাতসতী গ্রামের নাসির বাড়ির অবস্থা। ২২ আগস্ট ২০২৪। ছবি: সংগৃহীত

ঘটনাটি ঘটেছে ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের সাতসতী গ্রামে।

আলীম উল্লাহর ভাতিজা গোলাম সরোয়ার জানান, চার দিন অসুস্থ থাকার পর শুক্রবার ভোরে মারা যান আলীম উল্লাহ। তখন তার বাড়ি, গ্রাম, এমনকি ইউনিয়নের চারপাশেই অথৈ পানি।

ইউনিয়নের সব জায়গা আট-নয় ফুট পানির নিচে। আলীম উল্লাহর স্বজনরা মরদেহ দাফনের জন্য সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে ফেনীতে যোগাযোগের জন্য দুই দিন পর্যন্ত চেষ্টা করেন। কিন্তু ফেনী থেকে কোনো প্রকার সাড়া না আসায় বাধ্য হয়েই কলাগাছের ভেলায় মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন স্বজনেরা।

আলীম উল্লাহর ছেলে মাসুদ খান ওমানপ্রবাসী।

বাবার মৃত্যুর খবর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে জানতে পারলেও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি মাসুদ। ফলে বাবার মরদেহ ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়ার খবর তিনি পান অনেক পরে।

বিষয়টি কোনো ভাবেই মানতে পারছেন না মাসুদ। আক্ষেপের সুরে শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, 'আমার বাবাকে গতকাল বিকেলে কলাগাছের ভেলা দিয়ে বন্যার পানিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আপনারা যারা ওখানে উপস্থিত ছিলেন, তারা কীভাবে পারলেন এটি?'

'দরকার হলে বাইরে ভেলাতে রেখে আরেকটা দিন অপেক্ষা করতেন। আপনাদের যদি কেউ মরতো, তাহলে কি ছেড়ে দিতে পারতেন? কোনো উপায় বের করে তো পানি নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন! কার আদেশে এত তাড়াহুড়ো করতে হলো?'

এর আগে বন্যার পানির কারণে বাবার মরদেহ দাফন করতে স্বজনেরা ব্যর্থ হওয়ায় শুক্রবার ও শনিবার ওমান থেকে দিনভর মাসুদ পরম আকুতির সঙ্গে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়েছেন।

ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, 'সাতসতী নাছির বাড়িতে এখনও একটা স্পিডবোট আসলো না। সেনাবাহিনী ঢুকতে দিচ্ছে না। উদ্ধার করতে না পারেন, অন্য রেসকিউ টিমদেরও কেন ঢুকতে দিচ্ছেন না। আমার বাবার লাশ পড়ে আছে। বাচ্চাসহ সবাই না খেয়ে আছে।'

মাসুদ আরেক পোস্টে লিখেছেন, 'হে আল্লাহ আমার বাবা যেন একটু মাটি পায়। আল্লাহ তুমি সবকিছুর মালিক। তুমি এই দুর্দিনে আশ্রয় দাও। অন্তত তার কবর জিয়ারত করতে পারি, ওই সুযোগ করে দাও।'

বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তাৎক্ষনিকভাবে মাসুদ ফেসবুকে লিখেছিলেন, 'আমার বাবা দুনিয়াতে আর নেই। শেষবারের মতো একটু কথাও বলতে পারিনি বন্যা আর নেটওয়ার্কের কারণে।'

দ্য ডেইলি স্টারকে মাসুদ খান বলেন, 'বন্যার কারণে বুধবার রাতের পর কারো সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারিনি। শুক্রবার ভোরে বাবা মারা যাওয়ার পর সকাল ১০টার দিকে ঢাকার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমি জানতে পারি। বাড়িতে একজনের মোবাইলে তখনো একটু চার্জ ছিল। তিনি ঢাকায় থাকা আমার এক আত্মীয়কে খবর জানিয়ে আমাকে জানাতে বলেন।'

মরদেহ ভাসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, 'বাবার মরদেহ নিয়ে সারাদিন স্বজনেরা অপেক্ষায় ছিল। ফেনীতেও তারা বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। নেটওয়ার্ক না থাকায় আমিও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। বাড়িতে আমার মা ও বোন আছে। সম্ভবত তাদের সঙ্গে কথা বলে দুইদিন মরদেহ নিয়ে অপেক্ষা করার পর ভাসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।'

'মৃত্যুর পর আমার বাবা একবিন্দু মাটি পায়নি, এই আফসোসটা আমার আজীবন থাকবে', বলেন তিনি।

ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া মরদেহটি কেউ পেলে যেন শুকনো স্থানে দাফন করেন এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মৃত ব্যক্তির স্বজনদের জানান—এই অনুরোধ জানিয়েছেন স্বজনেরা।

এ জন্য তারা ভাসিয়ে দেওয়া মরদেহের সঙ্গে আকুতি ভরা একটি চিঠি বেঁধে দিয়েছেন। চিঠিতে লিখেছেন, 'এই মৃতদেহটি অতিরিক্ত বন্যার কারণে আমরা দাফন করিতে পারিনি। দুইদিন অতিবাহিত হওয়ার পরে আমরা পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছি। সাথে আমাদের এলাকার নাম-ঠিকানাসহ ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ শুকনো জায়গা পান, তাকে কবর দিয়ে দিবেন এবং আমাদের ওই ঠিকানা যোগাযোগ করবেন। আপনাদের কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ থাকবো। ঠিকানা—নাছির ভূঁইয়া বাড়ি, ৬ নম্বর ওয়ার্ড, গ্রাম সাতসতী, ১১ নং মোটবী ইউনিয়ন, ফেনী সদর, ফেনী।'

Comments

The Daily Star  | English
two new murder cases filed against Sheikh Hasina

Hasina made accused in another ICT case

Another complaint has been filed with the International Crimes Tribunal (ICT) against former prime minister Sheikh Hasina over the killing of Farhan Faiyaz, a 17-year-old student of Dhaka Residential Model College (DRMC), during the student movement in the city's Mohammadpur area on July 18.

45m ago