গ্রীষ্মে বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি কিনতে দরকার ৪.৪৫ বিলিয়ন ডলার

পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট।
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) অনুমান করছে, এই সময়ে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে জ্বালানি খরচের জন্য অন্তত ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।

ভারতের আদানি পাওয়ার ও শেভরনকে প্রদেয় অর্থ যোগ করলে এই অংক ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, গ্রীষ্মে গরম বেড়ে যাওয়ায় এবং বোরো সেচের মৌসুম হওয়ায় জুন পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকবে।

তা ছাড়া, চলতি বছর রমজান মাস আসছে এই মৌসুমেই। মানুষের বাড়তি স্বস্তির জন্য রোজার পুরো মাস নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা দরকার।

পিডিবির অনুমান, এই ৫ মাসে প্রতিদিন ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে।

পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে প্রতিদিন প্রায় ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট।

গত বছর সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছিল এপ্রিলে, ১৪ হাজার ৭৭৮ মেগাওয়াট।

পিডিবির মুখপাত্র শামীম হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা হয়তো এ বছর লোডশেডিং থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাব না। কিন্তু আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।'

তিনি আশা করেন, গ্রীষ্মের মাসগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো বিঘ্ন ঘটবে না।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে সরকার তহবিল সরবরাহ করতে সক্ষম হবে কি না, সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। কেননা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়ায় জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হয় এবং এর প্রভাবে গত বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে তীব্র লোডশেডিং হয়েছিল। রিজার্ভের ওপর চাপ এখনো কমেনি।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৬ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে, যা ১ বছর আগের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এই রিজার্ভ ৪ মাসের আমদানি বিল মেটানোর জন্য যথেষ্ট।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি আমদানির জন্য ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা সম্ভব হবে না।'

তিনি জানান, সরকার দেশীয় গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেচের জন্য সোলার সিস্টেম স্থাপনকে বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করার পরিকল্পনা নিয়েছিল।

'তাহলে জ্বালানি আমদানির জন্য কেন এই বিপুল পরিমাণ টাকার দরকার হবে?' তিনি প্রশ্ন করেন।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'ডলার বাঁচাতে সরকার বিভিন্নখাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। পিডিবির এই পরিকল্পনা সরকারের প্রচেষ্টার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।'

বুয়েটের পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, 'প্রতিদিন ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার জন্য পিডিবির পরিকল্পনা প্রশংসনীয়। কারণ এর মাধ্যমে লোডশেডিং ও জনগণের দুর্ভোগ কিছুটা কমবে। কিন্তু তারা এত ডলারের ব্যবস্থা কীভাবে করবে, সেটা চ্যালেঞ্জিং।'

চলমান ডলার সংকট পিডিবিরও উদ্বেগের বিষয়।

এই আর্থিক পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে পিডিবি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কারণ এর মাধ্যমেই সবচেয়ে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।

২০২১-২২ অর্থবছরে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রতি কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ছিল ৩ টাকা ৪৬ পয়সা। বিপরীতে, কয়লাচালিত কেন্দ্রে খরচ হয়েছে ৯ টাকা ১৭ পয়সা, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রে ২২ টাকা ১০ পয়সা ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রে ১৫৪ টাকা ১১ পয়সা।

২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের মধ্যে গ্যাসচালিত ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ, ফার্নেস অয়েলচালিত ২৫ দশমিক ২ শতাংশ, কয়লাভিত্তিক ১১ দশমিক ১ শতাংশ এবং ডিজেলচালিত ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

পিডিবি পেট্রোবাংলার কাছে প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাসের চাহিদা দিয়েছে।

সম্প্রতি অর্থ বিভাগের কাছে একটি চিঠিতে পেট্রোবাংলা লিখেছে, স্পট মার্কেট ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা মেটাতে তাদের ৫ মাসে প্রায় ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাটি জুনের মধ্যে স্পট মার্কেট থেকে ১০ থেকে ১২ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করছে। পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে আরও ২৪ কার্গো এলএনজি আসবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

তিনি জানান, এর জন্য প্রয়োজন হবে ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার।

তিনি বলেন, 'তারল্য সংকট থাকায় অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে। পিডিবি বলেছে, তাদের অতিরিক্ত গ্যাস লাগবে, কিন্তু আমরা কোম্পানির কাছ থেকে বকেয়া অর্থ এখনো পাইনি। বাংলাদেশ ব্যাংকও সহযোগিতা করছে না।'

অর্থ বিভাগের কাছে আরেকটি চিঠিতে পিডিবি পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ স্থানীয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করতে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে।

বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, পিডিবির চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল আমদানি করতে তাদের ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের জ্বালানি আমদানি করতে ২ বিলিয়ন থেকে ২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এর মধ্যে ১০ শতাংশ প্রয়োজন বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, 'বেশিরভাগ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন চালু আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লেও ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের চেয়ে কয়লা সস্তা হওয়ায় এটি একটু স্বস্তি দেবে।'

Comments