এলপিজি সিলিন্ডারের নির্ধারিত দাম কেবল কাগজেই
প্রতি মাসে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কিন্তু আমদানিকারক, পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতাদের কেউই সে দাম মানে না।
ফলে ন্যায্য দামে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যটি পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।
গত ২ আগস্ট বিইআরসি ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের খুচরা মূল্য ঘোষণা করে ১ হাজার ১৪০ টাকা। তবে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ভোক্তারা জানান, তাদের কেউই আগস্টে ১ হাজার ৪০০ টাকার কমে সিলিন্ডার কিনতে পারেননি।
এ বিষয়ে অন্তত ৩ জন এলপিজি পরিবেশক এবং ১০ জন খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। তারা সবাই বিইআরসি নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কোম্পানীগুলো থেকে এলপিজি সিলিন্ডার কেনার কথা জানিয়েছেন।
বাড়তি দামের জন্য খুচরা বিক্রেতারা পরিবেশকদের দোষারোপ করেন, আর পরিবেশকরা আঙ্গুল তুলেন আমদানিকারকদের দিকে।
আমদানিকারকেরা বেশি দামে বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করলেও বলছেন আমদানির ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা এবং ঋণপত্র (এলসি) খোলার চ্যালেঞ্জের কারণে বাজার একটু অস্থিতিশীল।
তবে বাজার বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এগুলো সবই খোঁড়া যুক্তি। বিইআরসি অংশীদারদের কাছ থেকে সব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করে প্রতি মাসে দাম নির্ধারণ করে।
তারা বলছেন, বাজারে কঠোর পর্যবেক্ষণ না থাকার কারণেই ব্যবসায়ীরা একে অন্যের দিকে আঙ্গুল তুলে পার পেয়ে যাচ্ছেন; ভুগতে হচ্ছে ভোক্তাদেরই।
সম্প্রতি রাজধানীর কচুক্ষেত, শেওড়াপাড়া, তেজতুরিবাজার, কারওয়ান বাজার, বংশাল, বনশ্রী ও মগবাজার এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অনেক জায়গায় ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডার ১৫০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।
অতিরিক্ত দামের পেছনে আরেকটি কারণ হিসেবে সরবরাহের ঘাটতির কথাও বলছেন পরিবেশকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমদানিকারক কোম্পানি ফ্রেশ এলপি গ্যাসের এক পরিবেশক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চলতি মাসে আমাদের কোম্পানি ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম অন্তত ৬ বার বাড়িয়েছে, প্রতিবার ২০ থেকে ৩০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে।'
গত ২০ আগস্ট তিনি ১ হাজার ১৯৭ টাকা দরে ৭০টি সিলিন্ডার কিনেছেন। তিনি বলেন, 'আমাদের ভ্যানে একবারে প্রায় ৩৬০টি সিলিন্ডার পরিবহন করা যায়। প্রতি ট্রিপে প্রায় ৮ হাজার টাকা বা সিলিন্ডার প্রতি ২২-২৩ টাকা খরচ হয়। কিন্তু আমরা কোম্পানী থেকে সেদিন মাত্র ৭০টি সিলিন্ডার পেয়েছি। ফলে প্রতি সিলিন্ডারের পেছনে আমাদের পরিবহন খরচ দাঁড়িয়েছে ১১৪-১১৫ টাকা।'
বিইআরসির নির্ধারিত দরে পরিবেশকদের ১ হাজার ৪৫ টাকায় পণ্যটি পাওয়ার কথা।
পরিবেশকদের প্রায়ই এলপিজি দাম সম্পর্কে জানিয়ে মোবাইলে মেসেজ পাঠায় আমদানিকারকরা, যারা অপারেটর নামেও পরিচিত। গত ১৪ আগস্ট পাঠানো একটি মেসেজে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১১৯৭ টাকা, ৩৩ কেজির সিলিন্ডার ৩০৬৭ টাকা, ৩৫ কেজির সিলিন্ডার ৩২৪৬ টাকা এবং ৪৫ কেজির সিলিন্ডার ৪১৬৪ টাকা।
বিইআরসি নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির ওই সিলিন্ডারগুলো যথাক্রমে ১০৪৫ টাকা, ২৮৭২ টাকা, ৩০৪৭ টাকা এবং ৩৯১৬ টাকায় বিক্রি করার কথা ছিল।
ওই পরিবেশক আরও বলেন, 'পরিবেশক চার্জ হিসেবে আমাদের সিলিন্ডার প্রতি ৫০ টাকা নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ঝামেলা এবং পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় আমরা ১০০ টাকা নিচ্ছি।'
জানতে চাইলে ফ্রেশ এলপি গ্যাসের চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ নুরুল আলম বলেন, 'আমরা বিইআরসি দামই অনুসরণ করছি। পরিবেশকদের আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, কিন্তু খুচরা বিক্রেতারা যারা দাম বাড়াচ্ছে তাদের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।'
পরিবেশকদের কাছেই তারা বেশি দামে বিক্রি করছেন, এমন তথ্যে কথা জানালে তিনি বলেন, 'আমরা বিইআরসি রেট অনুযায়ী দাম রাখার জন্য পরিবেশকদের কমিশন কমিয়ে দিয়েছি। পরিবেশকরা নির্ধারিত মূল্যের বাইরে যে কমিশন নিচ্ছে সেজন্য আমরা দায়ী নই।'
ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা একটি বড় সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বিইআরসি ডলারের দাম ১১ টাকা নির্ধারণ করেছে কিন্তু আমরা এলসি খুলতে প্রতি ডলার ১১৬ টাকা খরচ করছি। সে কারণে আমাদের আমদানির পরিমাণ কমাতে হয়েছে।'
আরেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেডের বিভাগীয় প্রধান জাকারিয়া জালাল জানান, এলসি খোলার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যার কারণে তারা প্রায় ৩০ শতাংশ এলপিজি আমদানি কমিয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টার একজন পরিবেশকের কাছ থেকে বেক্সিমকো এলপিজির দেওয়া একটি ক্যাশ মেমো সংগ্রহ করেছে। গত ২৪ আগস্টের ওই মেমোতে দেখা যাচ্ছে, ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার নির্ধারিত দরের চেয়ে তারা ২৮৫ টাকা বেশি এবং ২০ কেজির সিলিন্ডার ৪১০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করেছে।
রাজধানীর মিরপুর এলাকায় এই কোম্পানীর ১২ কেজির সিলিন্ডার ১৪৩০ টাকায় বিক্রি করছেন পরিবেশকেরা। খুচরা পর্যায়ে সেটার দাম দাড়াচ্ছে ১৫০০ টাকা, বাসায় পৌঁছে দেওয়া বাবদ আরও ৫০ টাকা যোগ করতে হচ্ছে গ্রাহকদের।
যোগাযোগ করা হলে বেক্সিমকো এলপিজির প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা এম মুনতাসির আলম বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, বেক্সিমকো শুধু বিইআরসি নির্ধারিত দামেই এলপিজি বিক্রি করছে না, সাথে তাদের পরিবেশকদের পরিবহন খরচও বহন করছে।
দুই আমদানিকারককে কারণ দর্শানো নোটিশ
গত ১১ জুলাই বিইআরসি দুটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান—ইউনাইটেড আইগ্যাস এলপিজি লিমিটেড এবং টোটালগ্যাসকে জুলাই মাসের শুরুতে পরিবেশকদের কাছে উচ্চ দামে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করার প্রমাণ পেয়ে কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে।
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দুই প্রতিষ্ঠানের একটিও নোটিশের জবাব দেয়নি। বিইআরসির এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, টোটালগ্যাস নোটিশের জবাব দিতে আরও সময় চেয়েছে। কিন্তু ইউনাইটেড এলপিজি ৩১ জুলাই দ্বিতীয় নোটিশ পাওয়ার পরেও কোনো জবাব দেয়নি।
ইউনাইটেড আইগ্যাস এলপিজির ব্র্যান্ড, কমিউনিকেশন অ্যান্ড পিআর-এর প্রধান এসএম ফারুক হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা বিইআরসির ১১ জুলাই-এর নোটিশের জবাব দিয়ে বলেছি যে, তারা যে পরিবেশকের কথা বলছেন, তিনি আমাদের নিজস্ব কোনো পরিবেশক নন। এরপর আমরা আর কোনো নোটিশ পাইনি।'
আর টোটালগ্যাসের কোম্পানি টোটালএনার্জির হেড অব অপারেশনস সবুর হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তার গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নেই। টোটালএনার্জির ম্যানেজিং ডিরেক্টর এএস কৃষ্ণান বিদেশে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিইআরসি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, 'ওই দুটি কোম্পানি এখনো কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব দেয়নি। আমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।'
তিনি বলেন, 'কোম্পানিগুলোর সাথে দাম নির্ধারণের আগে আমাদের মিটিং হয়, সেখানে কারা ডলারের যে রেটগুলো উপস্থাপন করে, তার ওপর ভিত্তি করেই ডলারের রেট নির্ধারণ করা হয়। পরিবহন খরচ, ট্যাক্স, পরিবেশকদের চার্জ সবকিছুই এলপিজির খুচরা দামের সঙ্গে ধরা হয়। তারপরও তারা কেন নির্ধারিত মূল্যটি মানে না তা আমি বুঝতে পারি না। এটি তো ব্যবসায়ের একটি নৈতিকতার বিষয়।'
বাজার মনিটরিংয়ে ঘাটতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এ জন্য আমাদের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হবে। কারণ আমাদের কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। আমরাও দেখতে পেয়েছি কিছু কিছু এলাকায় নির্ধারিত দাম মানা হচ্ছে না।'
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এম শামসুল আলম জানান, এই সেক্টরের ব্যবসায়ীরা সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্তকে নিজেদের অনুকূলে রাখার ক্ষমতা রাখে।
'আর সে ক্ষমতার প্রয়োগ করা তারা যা-খুশি তাই করতে পারে।'
'বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে তারা কখনো আমদানি কমিয়ে দেয়, কখনো বাড়তি মজুদ করে। একটি আধা-বিচারিক সংস্থা হিসেবে বিইআরসি চাইলে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে,' তিনি বলেন।
দীর্ঘ বিচারিক লড়াইয়ের পর, ২০২০ সালে উচ্চ আদালত বিইআরসিকে মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা প্রদান করেন।
'বিইআরসি ভোক্তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য। তাদের উচিত কোম্পানিগুলোকে একটি নির্দিষ্ট মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করা,' বলেন তিনি।
নির্ধারিত দামে এলপিজি পেতে গ্রাহকদেরও এগিয়ে আসতে হবে বলে জানান তিনি। বলেন, 'গ্রাহকদের উচিত খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে অর্থের রসিদ সংগ্রহ করা এবং বিইআরসিতে অভিযোগ করা।'
অনুবাদ করেছেন সুচিস্মিতা তিথি
Comments