রেকর্ড লোকসানে পিডিবি

এই সরকারি সংস্থাটি মূলত টাকার অবমূল্যায়ন, জ্বালানির খরচ বৃদ্ধি ও ভারত থেকে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ আমদানি করে ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা লোকসান করেছে।

রেকর্ড ভর্তুকি ও পাইকারি বিদ্যুতের দাম দুই দফায় প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়লেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই সরকারি সংস্থাটি মূলত টাকার অবমূল্যায়ন, জ্বালানির খরচ বৃদ্ধি ও ভারত থেকে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ আমদানি করে ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা লোকসান করেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'এগুলোর কোনোটিই এই বিপুল লোকসানের কারণ নয়, এগুলো উপসর্গ মাত্র। মূল কারণ সরকারের আমদানি নির্ভর জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন মডেল।'

বিপিডিবির সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনতে—প্রায় ৫৯ হাজার ২২ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি।

এরপর সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এ বাবদ খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৩০৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। জ্বালানি খরচ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যাওয়ায় এই খরচ আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬৬ শতাংশ বেড়েছে।

গত অর্থবছরে ৫২ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গ্যাস থেকে। বিদ্যুৎখাতে গ্যাসের দাম সরকার গত জানুয়ারিতে ১৭৮ শতাংশ বাড়িয়েছিল, যার প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচে।

গত অর্থবছরে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিপিডিবি বিদ্যুৎ কিনেছে ১০ হাজার ৭৮৮ কোটি ২৫ লাখ টাকার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।

গত অর্থবছরে ভারত থেকে প্রায় ১০ হাজার ৫১৫ গিগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ এসেছে। এর মধ্যে আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে এসেছে ১ হাজার ৫৯৮ গিগাওয়াট ঘণ্টা, যেটি গত ৪ এপ্রিল থেকে চালু হয়। তার আগের অর্থবছরে ভারত থেকে মোট ৭ হাজার ৬৪৪ গিগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ এসেছে৷

পিডিবির ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার ২২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় ৯৭ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।

কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে সংস্থাটি কিনেছে প্রায় ২ হাজার ৯৮৭ গিগাওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ, যার দাম পরিশোধ করতে হয়েছে ৩ হাজার ৭৪৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

সব মিলিয়ে পিডিবি গত অর্থবছরে ৮৮ হাজার ৪৫০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে ৯৬ হাজার ৮৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। ছয়টি বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে এই বিদ্যুৎ বিক্রি করেছে ৫০ হাজার ৮৫৮ কোটি ২৫ লাখ টাকায়।

গত অর্থবছরে পিডিবির গড়ে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুৎ কিনেছে ১১ টাকা ৩৩ পয়সায়, যা এক বছরের আগের তুলনায় ২৮ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। বছরের মধ্যে দুবার দাম বাড়ানোর পরেও ভর্তুকি মূল্যে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ৬ টাকা ৭০ পয়সায় বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করেছে সংস্থাটি।

সরকার গত অর্থবছরে ভর্তুকি দিয়েছে ৩৯ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৩ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।

'আমরা ২০১২ সাল থেকে সরকারকে বলে আসছি এ ধরনের ভর্তুকি নির্ভর বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে আসতে। বর্তমানে যে ব্যবস্থা চলছে, তাতে লোকসান হতেই থাকবে', বলেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বছরের পর বছর ধরে পিডিবির বিপুল লোকসানের মূল কারণ হিসেবে বলেন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সঙ্গে সরকারের চুক্তির ত্রুটির কথা।

আহসান এইচ মনসুরের ভাষ্য, 'এই ধরনের চুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রচুর মুনাফা করছে এবং পিডিবি লোকসান গুনছে। এই সব চুক্তিগুলো পুনরায় বিবেচনা করা উচিত।'

বিদ্যমান চুক্তির অধীনে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও একটি নির্দিষ্ট ফি পান, যাকে ক্যাপাসিটি চার্জ বলা হয়। এই ফি নেওয়ার মাধ্যমে পিডিবিকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয় যে, চাওয়া মাত্রই তাদেরকে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে।

বিপিডিবি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে গত অর্থবছরে পরিশোধ করা ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ উল্লেখ করেনি। তবে, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত সেপ্টেম্বরে সংসদে বলেছিলেন, সরকার ২০০৯ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'এ ধরনের মডেল শুধু পিডিবিকেই দুর্বল করছে না, অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।'

পিডিবির বিপুল লোকসানের পেছনে ওভার ক্যাপাসিটিও আরেকটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের ওভার ক্যাপাসিটি আগামী বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশ অতিক্রম করবে। পুরানো ও অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে পর্যায়ক্রমে কমিয়ে এটি হ্রাস করা উচিত।'

চলতি অর্থবছরে নতুন করে ৩ হাজার ১৪৯ মেগাওয়াট সক্ষমতা যোগ হয়ে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৯১১ মেগাওয়াটে। অথচ, গত ১৯ এপ্রিল দেশে ছিল সর্বোচ্চ বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট।

জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, 'আমদানি নির্ভরতা থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত পিডিবি কখনোই এমন লোকসানি অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবে না।'

তিনি বিদ্যুতের প্রতিযোগিতামূলক মূল্য পেতে সরকারের বর্তমান আইনের বিশেষ বিধানগুলো পরিবর্তন করার আহ্বান জানান।

Comments