উপকূলরেখায় অবাধে চিংড়ি পোনা আহরণ, বিপন্ন সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য

গত বছর পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় ওয়ার্ল্ড ফিশ, বাংলাদেশ কর্তৃক ‘এনহ্যান্সড কোস্টাল ফিশারিজ ইন বাংলাদেশ (ইকোফিশ-২) অ্যাক্টিভিটি’র অধীনে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, একটি বাগদা চিংড়ির পোনা ধরার সময় কমপক্ষে ৭০-৮০টি অন্যান্য চিংড়ি ও মাছের প্রজাতি ধ্বংস হয়।
চিংড়ির পোনা
সামুদ্রিক মাছের প্রজননের জন্য বঙ্গোপসাগর ও নদী মোহনায় মাছ ধরার ক্ষেত্রে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বাগদা চিংড়ির পোনা ধরার কাজ অব্যাহত আছে। ছবি: মোকাম্মেল শুভ/স্টার

কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে খুলনার সুন্দরবন পর্যন্ত উপকূলীয় জেলাগুলোতে নিষিদ্ধ মশারি জাল দিয়ে বাগদা চিংড়ির পোনা ধরার কাজ অব্যাহত থাকার কারণে ইলিশসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের প্রজননের জন্য বঙ্গোপসাগর ও নদী মোহনায় মাছ ধরার ক্ষেত্রে যে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তা তেমন ফলপ্রসু হচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, দেশের প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদের ওপর ব্যাপক ধ্বংসাত্মক প্রভাবকে উপেক্ষা করে এই বিস্তীর্ণ উপকূলরেখা ও নদীর মোহনায় লাখ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু টানা বা বেহুন্দী জাল দিয়ে চিংড়ির পোনা ধরছেন। এই জালগুলো মশারির মতো প্রায় নিশ্ছিদ্র। এতে চিংড়ির সঙ্গে নানা জাতের মাছের পোনা ও সামুদ্রিক প্রাণীর লার্ভাও মারা পড়ছে। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য।

গত বছর পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় ওয়ার্ল্ড ফিশ, বাংলাদেশ কর্তৃক 'এনহ্যান্সড কোস্টাল ফিশারিজ ইন বাংলাদেশ (ইকোফিশ-২) অ্যাক্টিভিটি'র অধীনে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, একটি বাগদা চিংড়ির পোনা ধরার সময় কমপক্ষে ৭০-৮০টি অন্যান্য চিংড়ি ও মাছের প্রজাতি ধ্বংস হয়।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান বলেন, 'বৃষ্টির কারণে মে, জুন ও জুলাই মাসে সমুদ্রের পানি মিষ্টি হয়ে আসলে উপকূলরেখার কাছে অনেক ধরনের সামুদ্রিক মাছ ডিম পাড়ে। এর বাইরে সাগরে ছাড়া ডিমগুলোও ঢেউয়ের টানে ভেসে তীরে আসে। এই ডিমগুলো লার্ভা ও পোনাতে পরিণত হওয়া পর্যন্ত মূলত ম্যানগ্রোভ বন এবং উপকূলীয় অঞ্চলের উপকূলরেখার কাছে থাকে। এ অবস্থায় চিংড়ির পোনা ধরার জন্য মশারি জাল বসিয়ে অন্যান্য চিংড়ি ও মাছের পোনার পাশাপাশি জিও প্লাংটন এবং পোস্ট লার্ভা ধ্বংস করা হচ্ছে।'

এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ভাষ্য, চিংড়ি পোনা ধরার এই প্রক্রিয়াটি আসলে জলজ জীববৈচিত্র্যকেই বিপন্ন কর তুলেছে।

চিংড়ির পোনা
চিংড়ির সঙ্গে অন্যান্য মাছের পোনা ও সামুদ্রিক প্রাণীর লার্ভাও মারা পড়ছে। হুমকির মুখে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য। ছবি: মোকাম্মেল শুভ/স্টার

দেশের অন্যতম বৃহৎ শুঁটকি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সাগর ড্রাই ফিশের মালিক আব্দুস শুক্কুরও বলছেন, সাগরে বাগদা চিংড়ির পোনা ধরার কারণে সাগরে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা অনেকাংশে হারিয়েছে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে বাগদা চিংড়ির পোনা ধরতে গিয়ে আহরণকারীরা অন্য মাছের পোনা ও ডিম নষ্ট করছে।'

এ ব্যাপারে আব্দুস শুক্কুরের পর্যবেক্ষণ হলো, এই প্রক্রিয়ায় বাগদা চিংড়ির পোনা ধরা বন্ধ করতে পারলে দেশে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানিও বৃদ্ধি করা সম্ভব।

শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (শাব) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নজিবুর রহমান জানান, নিষেধাজ্ঞার কারণে সাগর থেকে মা চিংড়ি ধরা বন্ধ আছে। তাই হ্যাচারিগুলোতেও চিংড়ির পোনা উৎপাদনের কাজ এখন বন্ধ।

কিন্তু চলতি মৌসুম চিংড়ি চাষের জন্য খুবই উপযোগী বলে মন্তব্য করে নজিবুর রহমান বলেন, 'চাষিদের কাছে চিংড়ি পোনার চাহিদা আছে। তাই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনেকে উপকূল ও নদীর মোহনা থেকে চিংড়ি ধরছেন।'

নজিবুর রহমানের কাছ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৬০টি চিংড়ি হ্যাচারিতে মৌসুমে প্রায় ১ হাজার কোটি চিংড়ি পোনা উৎপাদিত হয়। এর বিপরীতে প্রায় ৮০০ কোটি পোনার চাহিদা আছে। ফলে হ্যাচারিতে উৎপাদন চললে প্রকৃতি থেকে আহরণ করা পোনার তেমন কোনো চাহিদা থাকে না। 

উপকূলরেখা ও নদীর মোহনায় ঠিক কত সংখ্যক মানুষ চিংড়ির পোনা ধরার কাজে নিয়োজিত আছেন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে এই খাতসংশ্লিষ্টদের ধারণা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই সংখ্যা ৫ লাখের কম নয়।

চিংড়ির পোনা
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনেকে উপকূল ও নদীর মোহনা থেকে চিংড়ি ধরছেন। ছবি: মোকাম্মেল শুভ/স্টার

কক্সবাজারের সমিতিপাড়ার জেলে আব্দুল হামিদ বলছেন, নিষেধাজ্ঞার সময়টাতে সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট সঞ্চিত অর্থ তাদের কাছে থাকে না। এ সময় সরকারের কাছ থেকে তেমন কোনো সহায়তাও পান না তারা। ফলে চিংড়ির পোনা ধরা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না তাদের কাছে।

একই এলাকার আরেক জেলে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে জানা যায়, ১০০ চিংড়ির পোনা বিক্রি করে তিনি ৪০ টাকা পান। দিনে সাধারণত ৫০০ থেকে ১০০০ হাজার পোনা ধরেন তিনি।

এদিকে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য এমন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড বন্ধ না হওয়ার কারণ হিসেবে মৎস অধিদপ্তরের নজরদারির অভাবকেও দায়ী করছেন অনেকে। তাদের বক্তব্য, বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় চিংড়ির পোনা সংগ্রহ বন্ধ করার জন্য একটি আদেশ জারি করেছিল। কিন্তু তা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে।

এ অবস্থায় চলতি মৌসুমেও কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ বেশিরভাগ উপকূলীয় জেলায় অবাধে চিংড়ি পোনা ধরার পাশাপাশি অন্যান্য প্রজাতির মাছের পোনা ধ্বংস করার কাজ চলছে।

জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পরিকল্পনা ও জরিপ) সৈয়দ মো. আলমগীর বলেন, 'উপকূলীয় জেলাগুলোতে কর্মরত মাঠ কর্মকর্তাদের নজরদারি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা চিংড়ি পোনা ধরার কাজটি প্রতিরোধ করতে বলেছি।'

একইসঙ্গে চিংড়ি পোনা বিক্রির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

Comments