সুন্দরবনের ‘জলদানো’

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বদলে যাওয়া পরিবেশের কারণে লোনা পানির কুমিরের প্রাকৃতিক প্রজনন বাড়ছে না। 
কুমির
পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদীর কুমির। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে টিকে থাকা সরীসৃপ গোত্রের প্রাণীর মধ্যে লোনা পানির কুমিরই দৈর্ঘ্যে সবচেয়ে বড়। আর বাংলাদেশে কেবল সুন্দরবন এলাকাতেই প্রাকৃতিক পরিবেশে লোনা পানির কুমির দেখা যায়।

বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এই বনের যে সমৃদ্ধ প্রাণবৈচিত্র্য, তাতে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে এই কুমির। বনের জটিল বাস্তুতন্ত্রেও রয়েছে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। 

প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক পরিবেশে বাংলাদেশের লোনা পানির একেকটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ কুমিরের দৈর্ঘ্য ৫-৭ মিটার পর্যন্ত হয়। ওজন হয় ৪০০ থেকে ১০০০ কেজি পর্যন্ত।

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বদলে যাওয়া পরিবেশের কারণে লোনা পানির কুমিরের প্রাকৃতিক প্রজনন বাড়ছে না। 

তাই উপকূলীয় এলাকার অল্প লবণাক্ত পানি এবং নদী মোহনায় বাস করা কুমিরের এই প্রজাতিটিকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন।

কুমির
পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদীর কুমির। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

লোনা পানির কুমিরের চোয়াল চওড়া এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী। এরা মাংসাশী। নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, সাপ, বানর, হরিণ এমনকি মানুষও শিকার করে।

এ কারণে সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদগুলোর বাসিন্দাদের কাছে কুমির একটি আতংকের নাম। তাই স্থানীয় বিভিন্ন লোকাচারেও আছে কুমিরের সদর্প উপস্থিতি।

জনপদের বাস্তুভিটা রক্ষায় বাস্তুদেবীকে সন্তুষ্ট করতে বাংলা বছরের পৌষ সংক্রান্তিতে যে বাস্তুপূজা অনুষ্ঠিত হয়, সেই বাস্তুদেবী আসেন কুমিরের পিঠে চড়ে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে শত শত বছর ধরে এই পূজা হয়ে আসছে। 

বাস্তুপূজায় কুমিরই প্রধান অনুষঙ্গ হওয়ায় মানুষের মুখে মুখে এখন তা কুমির পূজা নামে পরিচিতি লাভ করেছে। আবার পূজার এ কুমিরকে নিয়েও রয়েছে নানা কাহিনী।

কুমির
পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদী থেকে কুমির। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

পূজা শেষে মাটির তৈরি এ কুমিরের গলা কাটতে হয়। গলা কেটে প্রতীকী হত্যা করা না হলে মাটির কুমির জীবন্ত হয়ে জনপদের মানুষকে আক্রমণ করতে পারে বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।

আবার সুন্দরবনের জল ও বনজীবীরা বাঘের হাত থেকে বাঁচতে যেমন বনবিবির পূজা করেন, তেমনি কুমিরের হাত থেকে নিস্তার পেতে কুমির দেবতা কালু রায়ের পূজা করার রীতিও আছে।

সুন্দরবনের লোনা পানির কুমির নিজেদের আবাসস্থল কঠোরভাবে পাহারা দেয়, অর্থাৎ এরা নিজেদের এলাকায় অপরিচিত কুমির কিংবা অন্য কোনো প্রাণীকে ঢুকতে দেয় না।

দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে এ প্রজাতির কুমির সংরক্ষিত। তাই এ জাতের কুমির শিকার, হত্যা অথবা এর ক্ষতি করা বাংলাদেশের আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ।

লোনা পানির কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও লালন-পালনের জন্য ২০০০ সালে সুন্দরবনের করমজলে বন বিভাগের উদ্যোগে যে কুমির প্রজনন কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়, সেখান থেকে এ পর্যন্ত সুন্দরবনের নদী-খালে ২০০টির বেশি কুমির অবমুক্ত করা হয়েছে। 

গত ১৪ মার্চ প্রথমবারের মতো শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে সুন্দরবনের নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে দুটি কুমির। ওইদিন দুপুর ও রাতে সুন্দরবনের ভদ্রা নদীতে লোনা পানির কুমির দুটিকে অবমুক্ত করা হয়।

বন বিভাগ বলছে, কুমিরের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পিঠে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে নদীতে অবমুক্তের ঘটনা এশিয়ায় এই প্রথম। এর মাধ্যমে সুন্দরবনের নদীতে কুমিরের চলাচল ও অবমুক্ত করা কুমিরের জীবদ্দশার বিভিন্ন পর্যায়ের তথ্য জানা যাবে।

সম্প্রতি পূর্ব সুন্দরবনের শ্যালা নদী থেকে কুমিরের ছবিগুলো তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী হাবিবুর রহমান।

Comments