ভূগর্ভস্থ মিঠা পানি ব্যবহার-সংরক্ষণের কৌশল তৈরিতে অবদান রাখবে পাউবোর গবেষণা

আর্সেনিক, লবণাক্ততা, ম্যাঙ্গানিজ এবং আয়োডিন—এ সমস্ত রাসায়নিক-খনিজ পদার্থ বিভিন্ন অনুপাতে পানিতে মিশ্রিত হলে তা মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মাটির নিচের পানির গুণমান সম্পর্কে আমরা কীভাবে জানব?
প্রধান গবেষক ও পাউবো পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। আমরা অনেক বড় একটি ডেটা সেট তৈরি করেছি, যার সাহায্যে এখন ভূগর্ভস্থ মিঠা পানির ব্যবহার এবং সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত একটি কৌশল তৈরি করা যাবে।’
প্রধান গবেষক ও পাউবো পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। আমরা অনেক বড় একটি ডেটা সেট তৈরি করেছি, যার সাহায্যে এখন ভূগর্ভস্থ মিঠা পানির ব্যবহার এবং সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত একটি কৌশল তৈরি করা যাবে।’

ভূগর্ভস্থ পানি প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের একটি বড় সম্পদ। কিন্তু ভূগর্ভস্থ মিঠা পানির স্তর ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে ও দূষণের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।

আর্সেনিক, লবণাক্ততা, ম্যাঙ্গানিজ এবং আয়োডিন—এ সমস্ত রাসায়নিক-খনিজ পদার্থ বিভিন্ন অনুপাতে পানিতে মিশ্রিত হলে তা মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মাটির নিচের পানির গুণমান সম্পর্কে আমরা কীভাবে জানব?

কিছুদিন আগে পর্যন্ত পানির গুনগত মান নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। কিন্তু গত ৩ বছরে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এক দল গবেষক একটি প্রকল্প শেষ করেছেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পানির গুনগত মান নিয়ে জানা গেছে, যা ভূগর্ভস্থ পানির সম্পদের ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব ঘটাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রধান গবেষক ও পাউবো পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। আমরা অনেক বড় একটি ডেটা সেট তৈরি করেছি, যার সাহায্যে এখন ভূগর্ভস্থ মিঠা পানির ব্যবহার এবং সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত একটি কৌশল তৈরি করা যাবে।'

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, আর্সেনিকের মাত্রা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক ধরে কয়েকটি স্থানীয় গবেষণা এবং পরীক্ষা থেকে এর ক্রমবর্ধমান হুমকি সম্পর্কে খুঁটিনাটি আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু এ নিয়ে সামগ্রিক ধারণা তৈরির জন্য একটি ব্যাপক ও দেশব্যাপী মূল্যায়ন প্রয়োজন ছিল। কারণ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত এই প্রকল্পের তথ্য বিশ্লেষণে সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

ড. আনোয়ার বলেন, 'আমাদের অবশ্যই খুব বিচক্ষণতা ও সতর্কতার সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে হবে। ডেটা আমাদের তাই বলছে। নির্বিচারে পানি ব্যবহারে বিপর্যয় আসন্ন।'

সেচ, শিল্পায়ন ও বড় শহরগুলোতে পানি সরবরাহের জন্য অপরিকল্পিত নিষ্কাশনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির গুণমান ধীরে ধীরে বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।

আনুমানিক ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের বাসস্থান ঢাকায় পানির স্তর বছরে ৭ ফুট (দুই মিটার) নেমে যাচ্ছে বলে রেকর্ড করা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে, ঢাকার ভাগ্য একদিন কেপটাউন বা জোহানেসবার্গের মতো হতে পারে। এ শহরগুলোতে বৃষ্টির পানি সঞ্চয় করে সেখান থেকে নগরবাসীকে অল্প পানি সরবরাহ করা হয়।

রাজধানীর বাইরের পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়। নলকূপ, যেগুলো প্রায় এক দশক আগেও খাবার পানির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হত, সেগুলো এখন আর ১৬৫ ফুট নিচে মিঠা পানি তুলে আনতে পারে না। অগভীর নলকূপের পানিতে আর্সেনিক থাকে এর সঙ্গে আরও আছে ম্যাঙ্গানিজ ও আয়োডিন—যেগুলো পানিকে অনিরাপদ করে তোলে। তাই ১ হাজার ফুট নিচ থেকে বিশুদ্ধ পানি আনার জন্য এখন গভীর নলকূপেই ভরসা।

তবে ১৯টি উপকূলীয় জেলায় ১ হাজার ফুট গভীরতার পানিতেও লবণাক্ততা পাওয়া যায়। পিরোজপুর ও গোপালগঞ্জের মতো মধ্য উপকূলীয় জেলাগুলোতেও খাবার পানির অবস্থা করুণ।

অনন্য ভূতাত্ত্বিক অবস্থার কারণে বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। বদ্বীপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে না, যার মধ্যে রয়েছে লবণাক্ত পানির উপকূলীয় জেলা।

ভূগর্ভস্থ পানি নিষ্কাশন বনাম পরিপূরণের (বৃষ্টি বা অন্যান্য পানির উৎসের মাধ্যমে) অনুপাত বাংলাদেশের সব অঞ্চলে খুব একটা উৎসাহজনক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশেষত, ধান উৎপাদনকারী উত্তরাঞ্চল বেশ বিপদের মুখে রয়েছে বলা যায়। 

অন্যদিকে, বাংলাদেশের পশ্চিমা অঞ্চলগুলোতে সাধারণত পূর্বাঞ্চলের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত হয়। ফলে পশ্চিমে ভূগর্ভস্থ পানি কমলেও পূর্বে কমছে না।

ধান উৎপাদনকারী উত্তরাঞ্চল ছাড়াও বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চল, বড় শহর ও শিল্পাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলাশয়ের প্রাকৃতিক পরিপূরণ প্রক্রিয়াও ভালোভাবে কাজ করছে না।

টেকসই ও নিরাপদ পানির উৎস নিশ্চিত করতে পাউবো প্রকল্প বিভিন্ন ধরনের প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোকে সমন্বিত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—বিভিন্ন এলাকার পানির স্তর, লবণাক্ততা ও বিষাক্ততার মাত্রা এবং কোন কোন এলাকায় পানির চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম, কোথায় বাড়তি পানি আছে, কোথায় পরিপূরণ ঠিক মতো হচ্ছে এবং কোন জায়গাগুলোতে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন নেই, সেগুলো চিহ্নিত করা। 

এ প্রকল্পের অধীনে, পাউবো ৯০৫টি পর্যবেক্ষণ কূপকে আপগ্রেড করেছে যেখানে পানির স্তর, তাপমাত্রা এবং লবণাক্ততা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিমাপ করা যায়। এই তথ্যগুলো একটি কেন্দ্রীয় সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

ডা. আনোয়ার ও তার দল ১৬৫ ফুট থেকে এক হাজার ১০০ ফুট পর্যন্ত বিভিন্ন গভীরতায় ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন।

সারা দেশে ৯০১টি কূপ থেকে শীত ও বর্ষা মৌসুমে সমানভাবে এক হাজার ৮০২ টি নমুনা নেওয়ার পর, পানির প্রয়োগ ও রাসায়নিক গুণমান নির্ধারণের জন্য নমুনাগুলোর ওপর ২৭টি পরীক্ষা পরিচালনা করা হয়। এই বিশ্লেষণকে নিখুঁত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের অবার্ন ইউনিভার্সিটি এবং জার্মানির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব ডার্মস্টাডের গবেষণাগারে ৩০০টিরও বেশি নমুনা আবারও পরীক্ষা করা হয়।

গবেষকরা পরে ভূগর্ভস্থ পানির ল্যান্ডস্কেপ ম্যাপ করেন। তারা সব অঞ্চল জুড়ে সতর্কতার সঙ্গে ডেটা সংগ্রহ করেন। বছরের পর বছরের পরিশ্রমের পর ম্যানুয়ালটি অবশেষে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়েছে।

ডা. আনোয়ার বলেন, 'প্রকল্পটি আগামী বছর শেষ হবে। তবে আমাদের অবশ্যই গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে, কারণ ঐতিহাসিক ডেটা ভূগর্ভস্থ পানির পরিকল্পিত ব্যবহার এবং রিচার্জের জন্য কৌশল নির্ধারণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।'

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সুচিস্মিতা তিথি

Comments