হেমন্তের সন্ধ্যায় শীতের মৌতাত ছড়াচ্ছে ছাতিমের বুনো সৌরভ

রবি ঠাকুরেরও প্রিয় ফুল ছিল ছাতিম। এক সময় শান্তি নিকেতনের সমাবর্তনে ছাতিমের পাতা উপহার দেওয়ার চল ছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘ওই যে ছাতিম গাছের মতোই আছি/সহজ প্রাণের আবেগ নিয়ে মাটির কাছাকাছি।’
রুক্ষ হেমন্তের যতটুকু পেলবতা, তা যেন ছাতিমেরই দান। ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন রাসেল মাহমুদ শুভ।

নরম রোদের স্বল্পায়ু বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যার ছায়া ঘনিয়ে আসছে অনেকটা আগেভাগেই। রাত নামতেই এই পোড়া শহরে ক্রমশ বিরল হয়ে ওঠা বৃক্ষ, গাছ-গাছালি, লতাগুল্মের পাতা ও ঘাসের আচ্ছাদনে মেখে থাকছে পেলব শিশির। এর ভেতরেই কোথাও কোথাও পেট্রোলের ধোঁয়া, ধুলা, অ্যামোনিয়া আর আবর্জনার উৎকট গন্ধ ছাপিয়ে বাতাসে ভেসে আসছে ছাতিমের উদ্দাম, অ্যালকোহলিক, বুনো সৌরভ।

দ্বিজেন শর্মা ছাতিমকে চিহ্নিত করেছিলেন হেমন্তের অঙ্গনে দাঁড়িয়ে দুরন্ত শীতকে অভ্যর্থনা জানানো একমাত্র তরু হিসেবে।

এই নিসর্গবিদের ভাষায়, 'প্রস্ফুটনের এমন অবারিত উচ্ছ্বাস, ফুলের অক্লান্ত নির্ঝর এবং দূরবাহী প্রবল উগ্র গন্ধের ঐশ্বর্য আর কোনো হৈমন্তী তরুরই নেই।'

শরৎকে যেমন বর্ষারই প্রলম্বিত অংশ বলা হয়, হেমন্তও তেমন শীতের পূর্বরাগ। কিন্তু বড় বড় দালানকোঠা, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেলের মতো অতিকায় সব অবকাঠামোয় আকাশ ঢেকে যাওয়া এই নগরে হেমন্তের প্রকৃতি আপন বৈশিষ্ট্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। তাই সম্ভবত চুপিসারে আসা এই ঋতুকে এখানে অনেকটা চেনা যায় শরৎ শেষে ময়লা হতে থাকা সীমিত আকাশ, বিকেলের নরম রোদ, ছোট হয়ে আসা দিন আর ছাতিমের তীব্র সৌরভে।

রবি ঠাকুরেরও প্রিয় ফুল ছিল ছাতিম। এক সময় শান্তি নিকেতনের সমাবর্তনে ছাতিমের পাতা উপহার দেওয়ার চল ছিল। তিনি লিখেছিলেন, 'ওই যে ছাতিম গাছের মতোই আছি/সহজ প্রাণের আবেগ নিয়ে মাটির কাছাকাছি।'

সন্ধ্যার পর পথ চলতে চলতে হঠাৎ নাকে এসে লাগা বুনো সৌরভের ঝাপটা জানান দেয় এই তরু ও তার ফুলের অস্তিত্ব। ছবি: রাসেল মাহমুদ শুভ

আবার বিভূতিভূষণের 'আরণ্যক'-এ পাওয়া যায়, 'কিছুদূর উঠতেই কিসের মধুর সুবাসে মনপ্রাণ মাতিয়া উঠিল। গন্ধটা অত্যন্ত পরিচিত... চারিদিকে চাহিয়া দেখি ধনঝরি পাহাড়ে যে এত ছাতিম গাছ আছে তাহা পূর্বে লক্ষ্য করি নাই। এখন প্রথম হেমন্তে ছাতিম গাছে ফুল ধরিয়াছে, তাহারই সুবাস।... ছাতিম ফুলের সুবাস আরও ঘন হইয়া উঠিল, ছায়া গাঢ় হইয়া নামিল শৈলসানুর বনস্থলীতে... ভানুমতী একগুচ্ছ ছাতিম ফুল পাড়িয়া খোপায় গুঁজিল।'

প্রায় বৃক্ষহীন এই ঢাকা মহানগরে এখনো ছাতিমকে দুর্লভ বলা যাবে না। সন্ধ্যার পর পথ চলতে চলতে হঠাৎ নাকে এসে লাগা বুনো সৌরভের ঝাপটা জানান দেয় এই তরু ও তার ফুলের অস্তিত্ব।

নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন সড়ক, মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনা পার্ক, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, তেজগাঁওয়ে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণ, জাতীয় তিন নেতার মাজার প্রাঙ্গণ, জাতীয় প্রেসক্লাব সংলগ্ন চামেরি হাউস, আব্দুল গনি রোড ও হাতিরঝিলে গেলে পাওয়া যাবে ছাতিমের দর্শন।

দৃষ্টিসীমার চেয়ে খানিকটা উপরে থাকায় সাধারণ অবস্থান থেকে গন্ধ বিলানো ছাতিমের ফুল সহজে চোখে পড়ে না। কিছুটা উঁচু জায়গায় উঠলে দেখা যায় গাছজুড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ হালকা ঘিয়ে রঙের ফুল। মনে হবে যেন কেউ অসংখ্য ফুলের স্তবক তৈরি করে রেখেছে।

একগুচ্ছ ফুলকে ঘিরে থাকে চার থেকে সাতটি পাতা। আর এই জন্য সংস্কৃত ভাষায় এই গাছের নাম সপ্তপর্ণ বা সপ্তপর্ণা। দীর্ঘ লম্বাটে পাতাগুলো গাছের শাখায় যেন পরস্পর হাত ধরে থাকে। আর শেষে সব পাতা এক হয়ে গাছের মাথায় যেন একটা গাঢ় সবুজ ছাতা মেলে ধরে। এ কারণেই বুঝি এই তরুর নাম ছাতিম। গাছের নামেই যার ফুলের নামকরণ।

ঘন কালো ও নরম কাণ্ডের এই গাছের ডাল ভাঙলে সাদা দুধের মতো কষ বের হয়। গ্রামবাংলায় একসময় প্রচুর ছাতিম দেখা গেলেও এখন এটি অবাধ নিধনের শিকার। চীনের গুয়াংজি প্রদেশ ও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ছাতিমের আদি বাসভূমি।

দৃষ্টিসীমার চেয়ে খানিকটা উপরে থাকায় সাধারণ অবস্থান থেকে গন্ধ বিলানো ছাতিমের ফুল সহজে চোখে পড়ে না। ছবি: শেখ এনামুল হক/স্টার

ছাতিমের বৈজ্ঞানিক নাম অ্যালস্টনিয়া স্কলারিস (Alstonia scholaris)। স্কলারিস শব্দটির সঙ্গে বিদ্যা অর্থাৎ লেখাপড়ার যোগ আছে। এ ধরনের নামকরণের কারণ, ছাতিমের নরম কাঠ থেকে ব্ল্যাকবোর্ড ও পেনসিল তৈরি হয়। এ ছাড়া প্যাকিং বাক্স তৈরির জন্যও এর কাঠ ব্যবহার করা হয়।

ছাতিম গাছের ছাল ও আঠা জ্বর, হৃদরোগ, হাঁপানি, ক্ষত, আমাশয় ও কুষ্ঠ রোগ নিরাময়ে সহায়ক। এই অঞ্চলে ছাতিম পবিত্রতার প্রতীক হলেও এর ইংরেজি নাম কেন 'ডেভিলস ট্রি' তা ঠিক জানা যায় না।

কৃত্রিমতা যেখানে নিসর্গকে পুরোপুরি গ্রাস করেনি, সেখানেই হেমন্তের বৈশিষ্ট্যের স্বতঃপ্রকাশ। আবার এই ঋতুর রূপও হৃদয় বিগলিত করার মতো দৃষ্টিনন্দন নয়। বরং তা খানিকটা রুক্ষই বটে। এ কারণেই সম্ভবত জীবনানন্দ দাশ ছাড়া বাংলায় হেমন্তকে নিয়ে উচ্ছ্বাস করার মতো তেমন কাউকে পাওয়া যায় না।

আবার এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়—ছাতিম ছাড়া হেমন্ত-সন্ধ্যার বিবরণ পূর্ণাঙ্গ হয় না। ছাতিমের গন্ধ যেন হেমন্তেরই গায়ের গন্ধ। তাই রুক্ষ হেমন্তের যতটুকু পেলবতা, তা যেন ছাতিমেরই দান।

Comments

The Daily Star  | English

Sea-level rise in Bangladesh: Faster than global average

Bangladesh is experiencing faster sea-level rise than the global average of 3.42mm a year, which will impact food production and livelihoods even more than previously thought, government studies have found.

1h ago