‘উন্নয়নে’ সংকটাপন্ন ইছামতী নদী

নদী ভরাট করে সংযোগ সড়ক
প্রায় ১২০ ফুট প্রশস্ত নদীতে ১৫ মিটারের ছোট একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর জন্য নদীর দুই পার ভরাট করে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে নদীকে ছোট করে ফেলা হয়েছে। সেতু নির্মাণ করায় জনগণের চলাচলে স্বস্তি এলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নদী। ছবি: স্টার

পাবনা সদর উপজেলার গয়েশপুর ইউনিয়নের মাসিমপুর ও ইসলামপুর গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে ইছামতী নদী।

কয়েক বছর আগেও দুই গ্রামের মানুষ বাঁশের সাঁকো দিয়ে নদী পার হতেন। তবে সম্প্রতি নদীর ওপর স্থাপিত সেতু সেই দুর্ভোগ দূর করলেও অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত এই সেতু এখন মৃতপ্রায় নদীকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলেছে।

মাসিমপুর ও ইসলামপুর গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ১২০ ফুট প্রশস্ত এ নদীতে ১৫ মিটারের ছোট একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। আর এটি করতে গিয়ে নদীর দুই পার ভরাট করে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে নদীকে ছোট করে ফেলা হয়েছে।

সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সেতু/কালভার্ট কর্মসূচি নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় পাবনা সদর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় ৭৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে সেতুটি নির্মাণ কাজ শুরু করে। গত বছর সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং সংযোগ সড়ক স্থাপন করে সেতুটি ব্যবহারও শুরু হয়।

মাসিমপুর গ্রামের আব্দুল মান্নাফ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এই সেতু এখন দুই গ্রামের মানুষের চলাচলে গতি এনেছে ঠিকই কিন্তু নদীটা ছোট হয়ে গেছে। সেতুর সাথে সংযোগ সড়ক স্থাপন করতে নদীর দুই পাশে কমপক্ষে ৭০/৮০ ফিট ভরাট করে সংযোগ সড়ক স্থাপন করা হয়েছে ফলে নদীটি আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

একই গ্রামের স্কুল শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, যখন ক্ষুদ্রাকৃতির এ সেতু নির্মাণ করা হয় তখন গ্রামবাসীরা প্রশ্ন তুললেও ঠিকাদারের লোকজন তাদের বলে, সেতু করতে না পারলে অর্থ ফেরত যাবে। ফলে গ্রামবাসীরা তাদের বাধা দেয়নি।

সাইফুল বলেন, নবনির্মিত সেতু গ্রামের মানুষের চলাচলে গতি নিয়ে এলেও অপরিকল্পিতভাবে সেতু নির্মাণ করায় মৃতপ্রায় ইছামতী নদী আরও সংকুচিত হয়ে নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।

শুধু এই একটি সেতুই নয়, গত কয়েক বছরে পাশাপাশি আরও তিনটি এরকম ছোট আকারের সেতু নির্মাণ করা হয়েছে, যার সবগুলোই ১৫ মিটারের সেতু।

গ্রামবাসীরা জানায়, ইছামতী নদীতে এক সময় প্রাণ ছিল, সে সময় নদীতে চলত বড় বড় নৌকা, জেলেরা জাল ফেলে ধরত বড় মাছ। কালের বিবর্তনে সেই ইছামতী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। শহরের বর্জ্য আর কলকারখানার বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে পড়ছে নদীর পানি। এছাড়া নদী পারে ক্রমাগত দখলের উৎসব চলছে ফলে এমনিতেই হুমকির মুখে রয়েছে নদীর অস্তিত্ব। তার ওপর এ ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে নদীকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে বলে জানান গ্রামবাসী।

পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, জরিপ অনুযায়ী ইছামতী নদী সর্বনিম্ন প্রশস্ত ১২০ ফিট। নদীর বিভিন্ন অংশে পরিমাপ বিভিন্ন, তবে কোথাও ১২০ ফিট উচ্চতার নিচে নদী নেই। ইসলামপুর ও মাসিমপুরের এ অংশে নদীর প্রশস্ততা আরও বেশি।

সর্বনিম্ন ১২০ ফিট প্রশস্ত নদীতে ১৫ মিটার (৪৫ ফিট) এর সেতু নির্মাণ একটি তামাশা ছাড়া কিছু না বলে জানান তিনি।

এ ধরনের প্রকল্প নেয়ার আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়নি বলেও জানান তিনি।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে, পাবনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের চাহিদার ভিত্তিতে এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।

প্রকল্পের আওতায় ১৫ মিটারের বেশি দীর্ঘ কোনো সেতু নির্মাণ করার বিধান নেই বলেও জানান তিনি।

তবে ইছামতি নদীতে এ ধরনের কোনো প্রকল্প নতুন করে আর নেওয়া হবে না বলেও জানান তিনি।    

এ ব্যাপারে গয়েশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোতাহার হোসেন বলেন, গ্রামবাসীর দুর্ভোগ কমাতেই ইছামতী নদীতে পর্যায়ক্রমে তিনটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

নদীর চেয়ে ছোট আকৃতির সেতুর কারণে নদী সংকুচিত হয়ে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দখলের কারণে এমনিতেই নদী ছোট হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে ইছামতী নদী খননের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, নদী খননের সময় নদীর পূর্বাবস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনা যাবে বলে জানান তিনি।

এদিকে ইছামতী নদী নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা যখন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তখন এ ধরনের নির্মাণ প্রকল্প সরকারের অর্থের অপচয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), পাবনা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ খান বলেন, পাবনার সর্বস্তরের মানুষ গত কয়েক দশক ধরে ইছামতী নদীর দখল ও দূষণ দূর করে নদী খননের মাধ্যমে নদীতে প্রাণ ফিরিয়ে আনার দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। এ সময় এ ধরনের অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ সরকারের অর্থের অপচয় বলে মনে করি।

Comments