চট্টগ্রামে প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যে পরিপূর্ণ খাল, বর্ষায় তীব্র জলাবদ্ধতার আশঙ্কা

ছবি: অরুণ বিকাশ দে/স্টার

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি খাল প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যে ঢেকে গেছে, যা দ্রুত অপসারণ করা না হলে আগামী বর্ষায় তীব্র জলাবদ্ধতা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে জলাশয়ে প্লাস্টিক বর্জ্যের বিরূপ প্রভাব বোঝা না গেলেও বর্ষাকালে এসব প্লাস্টিক বর্জ্যই শহরে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিত দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সচেতনতার অভাব ও সুবিধাজনক স্থানে ডাস্টবিন না থাকায় স্থানীয়দের কেউ কেউ রাস্তা, নালা ও খালে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলেন। নির্বিচারে এসব বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলা হলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে জানান তিনি।

২০২২ সালে চুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বন্দর নগরীর মানুষ প্রতিদিন ৩ হাজার টন বর্জ্য উত্পাদন করে, এর মধ্যে ২৪৯ টন (৮.৩ শতাংশ) প্লাস্টিক এবং পলিথিন বর্জ্য।

সমীক্ষা অনুযায়ী, চসিক পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা দিনে ১০৯ টন প্লাস্টিক এবং পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারে এবং বাকি ১৪০ টন বর্জ্য খাল ও নর্দমায় গিয়ে পড়ে।

চুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুই শিক্ষার্থী পিয়াল বড়ুয়া এবং আল আমিন ২০২২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে তাদের গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন। ওই গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন চুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিত।

সম্প্রতি এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক স্বপন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ এসব প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য। এই অপচনশীল বর্জ্যগুলো নালা ও খালে পানির প্রবাহকে আটকে রাখে। প্লাস্টিক বর্জ্য জলাশয়ে ফেলা বন্ধ করতে হলে আগে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কমাতে হবে।'

'বাধ্যতামূলক পাট প্যাকেজিং আইন, ২০১০' এবং 'বাধ্যতামূলক পাট প্যাকেজিং নিয়ম-২০১৩' এর কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, 'ধান, চাল, গম, ভুট্টা, চিনি, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, আলু, ফিশ ফিড, পোল্ট্রি ফিড, ময়দা, মরিচ, ডাল, চালের কুঁড়া এবং সারসহ বেশ কয়েকটি প্রয়োজনীয় জিনিস বিতরণের জন্য পাটের প্যাকিং ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু আমরা বাজারে এই আইনের কোনো প্রয়োগ দেখি না।'

'মুদি দোকানে এবং কাঁচা বাজারে ব্যবহৃত প্রায় ৯০ শতাংশ ক্যারি-ব্যাগ প্লাস্টিক এবং পলিথিনের ব্যাগ,' বলেন তিনি।

ছবি: অরুণ বিকাশ দে/স্টার

প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জলাশয়কে বাঁচানোর প্রতিকার সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আইন বাস্তবায়নে প্রশাসনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কমাতে পারলে জলাশয় প্লাস্টিক বর্জ্যমুক্ত হবে।'

তিনি প্লাস্টিক বর্জ্যের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নিয়মিত খাল-নালা পরিষ্কার করার ওপরও জোর দেন।

সম্প্রতি নগরীর চারটি খাল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, প্লাস্টিক বর্জ্যে খালগুলো ঢাকা। সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক পণ্য ও পলিথিন রাস্তায় ও যেখানে সেখানে ফেলার কারণে এর একটি বড় অংশ শেষ পর্যন্ত ড্রেন ও খালগুলোতে গিয়ে জমা হয়।

বুধবার সরেজমিনে চকবাজার কেবি আমান আলী সড়কের ফুলতলা মোড়ের চাক্তাই খালে গিয়ে দেখা যায়, যতদূর চোখ যায় ততদূর প্লাস্টিক ও পলিথিনের বর্জ্যে ঢেকে আছে।

নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কর্তৃক বাস্তবায়িত একটি মেগা প্রকল্পের আওতায় একপাশে শ্রমিকদের খাল খননের কাজ করতে দেখা গেছে, খালটির অন্যপাশ প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যে ঢেকে আছে।

স্থানীয়রা বলছেন, এই পরিস্থিতি কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহে তৈরি হয়নি।

ফুলতলা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ফজলুর রহমান বলেন, 'অসচেতন মানুষজন বছরের পর বছর খালে পলিথিন বর্জ্য ফেলছে, অথচ এই উপদ্রব বন্ধ করার মতো কেউ নেই।'

সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর বিরজা খাল, জামাল খান খাল ও রাজাখালী খালেও একই অবস্থা।

ছবি: অরুণ বিকাশ দে/স্টার

সূত্র জানায়, নগরীর ৩৭টি খালের অধিকাংশেরই বিভিন্ন অংশে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যে ঢেকে আছে। এসব বর্জ্য শেষ পর্যন্ত বর্ষাকালে খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে  কর্ণফুলী নদীতে পড়ে।

২০১৯ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কয়েকজন গবেষক পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বিভিন্ন এলাকায় ২ মিটার থেকে সর্বোচ্চ ৭ মিটার পর্যন্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যের একটি স্তর রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র বলছে, পলিথিনের পুরু আস্তরণের কারণে কর্ণফুলিতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং কাজ ব্যাহত হয়ে থাকে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কর্মীরা নিয়মিত খাল-নালা পরিষ্কার করেন না বলে অভিযোগ করেছেন চকবাজার ফুলতলা মোড়ের স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয় সাধন দাস বলেন, 'চসিক পরিচ্ছনতা কর্মীরা নিয়মিত খাল পরিষ্কার করেন না। সে কারণে ফুলতলা এলাকার চাক্তাই খালে প্লাস্টিক বর্জ্য জমে স্তূপ হয়ে থাকে।'

জানতে চাইলে চসিক এর উপ-প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী জানান, তারা নিয়মিতই খাল পরিষ্কার করেন, কিন্তু যেদিনই খাল পরিষ্কার করা হয় তার পরদিনই আবার মানুষ প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলতে শুরু করে।

'চকবাজার ধুনির পুল থেকে ফুলতলা এলাকায় রাস্তার পাশে অবৈধ কাঁচা বাজার থাকায় বাজারের সব প্লাস্টিক বর্জ্য রাতের বেলায় খালে ফেলা হয়,' বলেন তিনি।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, 'অবৈধ প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ঠেকাতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়।'

'মাঝখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যস্ততার কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যায়নি। আমরা শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করব,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

July 6, 2024: 'Bangla Blockade' announced

Beyond Dhaka, protesters hold the streets with equal resolve

20h ago