বিষাক্ত মাটি, বিপন্ন জীবন: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবৈধভাবে চলছে ১১০ ইটভাটা

আইন অমান্য করে কৃষিজমির মাটি দিয়ে ইট তৈরি হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়ি বিজয়নগরের নাজিরবাড়ির ডিজিটাল ব্রিক ফিল্ডে। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই কাঠ পোড়ানো হচ্ছে এই ইটভাটায়। কালো ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, নষ্ট হচ্ছে ফসল। ছবি: মাসুক হৃদয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার বলরামপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আফরচান বেগম দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের রোগে ভুগছেন। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পারেন, বাড়ির কাছে কয়লা ও কাঠ পোড়ানো ইটভাটার কালো ধোঁয়াই তার অসুস্থতার প্রধান কারণ।

আফরচান বেগম বলেন, তাদের গ্রাম লাগোয়া দুটি ইটাভাটা--বনফুল ও ডিজিটাল ব্রীক ফিল্ড রয়েছে। গ্রামের একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বনফুল ইটভাটার চুল্লীটি দেখা যায়। ইটভাটা থেকে উড়ে আসা ছাইয়ে ঘরবাড়ি ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। গাছে ফল-ফুল আসছে না। আমগাছে মুকুল ধরার পর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডাবের গুটি ঝরে পড়ছে। লেবু, মরিচসহ কোনো ফসলই হচ্ছে না। অকালে মারা যাচ্ছে কবুতরসহ গৃহপালিত হাঁস-মুরগি। ইট পোড়ানোর মৌসুমে বাতাসের সঙ্গে এক ধরনের ধুলোকণা উড়ে এসে গায়ে পড়ে।

আফরচান বেগমের মতো বিজয়নগরের শশই, বুধন্তি, ইসলামপুর, চান্দুরা ও রামপুর গ্রামের শত শত কৃষক অপরিকল্পিত ইটভাটার আগ্রাসনে দিশেহারা। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ইটভাটার ধোঁয়ায় আশপাশের পরিবেশ বিপর্যস্ত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরা গ্রামে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে জিনান ব্রিকস। তিন দিকে কৃষিজমি ঘেরা এই ইটভাটার নিচু চিমনি থেকে বের হচ্ছে কালো ধোঁয়া। এর প্রভাবে পাশের জমির ধান গাছের পাতা ঝলসে গেছে। ছবিটি সম্প্রতি তোলা হয়েছে। ছবি: মাসুক হৃদয়

দুই দশক ধরে চলছে অবৈধ ইটভাটা

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৭৭টি ইটভাটার মধ্যে ১১০টি অবৈধভাবে চলছে। স্কুল, বাজার, কৃষিজমি ও বসতবাড়ির কাছে এসব ভাটা স্থাপন করা হয়েছে, যা আইনত নিষিদ্ধ। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রায় দুই দশক ধরে অনুমোদনহীনভাবে ইটভাটা চললেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কিছু ইটভাটার মালিক খোলাখুলিভাবে প্রশাসনকে 'ম্যানেজ' করে চলার কথাও স্বীকার করেছেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক রাকিবুল হাসান জানান, ১৮টি ইটভাটা হাইকোর্টে রিট করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফলে আইনি জটিলতায় ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

কৃষিজমিতে ইটভাটা

বিজয়নগরের চরইসলামপুর ইউনিয়নের নাজিরাবাড়ি গ্রামে একসময় ধান, সরিষা ও শীতকালীন সবজি চাষ হতো সেখানে এখন ইটভাটা। গ্রামের একমাত্র পাকা সড়কের পাশে মেসার্স ডিজিটাল ব্রিকস ও বনফুল ব্রিকস নামে দুটি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। সরাইলের শাহবাজপুর ইউনিয়নের রাজাবাড়িয়াকান্দি গ্রামেও একই অবস্থা। ইটভাটার ধোঁয়ায় স্থানীয়রা শ্বাসকষ্টসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। গত বছর সরাইলের চুন্টা ইউনিয়নের লোপাড়া গ্রামে প্রায় ৫০ একর বোরো ধানক্ষেত নষ্ট হয়েছে ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায়। সদর উপজেলার সুহিলপুর, বাকাইল ও আমিনপুর গ্রামেও একই চিত্র। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেও অন্তত ১০টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে, যা আইনত নিষিদ্ধ।

ইটভাটা মালিকদের দাপটে স্থানীয়রা অসহায়

চান্দুরা গ্রামের কাছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই গড়ে উঠেছে জিনান ব্রিকফিল্ড। তিন দিকে কৃষিজমি ঘেরা এই ইটভাটার ছোট চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় ধানখেতের পাতা মরে যাচ্ছে। ইটভাটা মালিকরা ট্রাক ও ট্রাক্টর দিয়ে ইট ও মাটি পরিবহনের সময় ধুলোবালিতে এলাকা ছেয়ে যায়। এতে ফসল ও ঘরবাড়ির ক্ষতি হচ্ছে। কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলদ ও বনজ গাছপালারও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ইটভাটা মালিকদের দাপটের কারণে স্থানীয়রা প্রতিবাদ করতে পারছেন না।

বিজয়নগরের নাজিরাবাড়ি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত বনফুল ব্রিকসের মালিক সাচ্চু মিয়া বলেন, 'আমরা পরিবেশ অধিদপ্তর, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করেই ইটভাটা চালাচ্ছি। যেহেতু ইটের চাহিদা আছে, আমরা উৎপাদন চালিয়ে যাব। কংক্রিট ব্লক তৈরির কথা শোনা গেলেও তা বাস্তবসম্মত নয়।'

পরিবেশবাদী সংগঠন 'তরী বাংলাদেশ-নদী ও প্রকৃতি রক্ষা সামাজিক আন্দোলন'-এর সদস্য সোহেল রানা ভূঁইয়া বলেন, 'একটি জেলায় এতগুলো অবৈধ ইটভাটা কীভাবে চলে? পরিবেশ বিধ্বংসী এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।'

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার সদস্য সচিব মো. নাসির মিয়া বলেন, 'ইটভাটা মালিকরা কৃষকদের আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে জমির উর্বর মাটি কেটে নিচ্ছে।'

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ইট প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক বলেন, ২০২৫ সাল পর্যন্ত মাটি দিয়ে ইট পোড়ানোর অনুমতি আছে। হঠাৎ করে ইটভাটা বন্ধ করে দিলে মানুষের কষ্ট হবে, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। পরিবেশের বেশি ক্ষতি না করলে ইটভাটার বিরুদ্ধে সহনশীল হওয়া উচিত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম জানান, অবৈধ ইটভাটার তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে, কিছু অভিযান চলমান রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেখানে জরিমানা ও অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'

Comments

The Daily Star  | English

From lost playgrounds to booming business

In the memories of those who grew up before the turn of the millennium, the playground was a second home.

35m ago