পাহাড়-প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে চলছে অবৈধ ২৮ ইটভাটা

আদালতের আদেশ অমান্য করে বান্দরবানে অবৈধভাবে লাইসেন্স ছাড়াই চলছে ২৮টি ইটভাটা, যার ১৭টি লামা ফাইতংয়ে। এসব ইটভাটায় দিনরাত পোড়ানো হচ্ছে প্রাকৃতিক বন থেকে কেটে আনা কাঠ, উড়ছে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া।
সরেজমিনে ফাইতং এলাকায় ১৭টি ইটভাটায় দেখা গেছে একই চিত্র।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব ইটভাটার কারণে কাটা হচ্ছে পাহাড়, ধ্বংস হচ্ছে ফসলি জমি। 'লোক দেখানো' অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হলেও কোনো ইটভাটা বন্ধ হয়নি।
জেলায় সবচেয়ে বেশি ১৮টি ইটভাটা লামা উপজেলায়। এ ছাড়া, নাইক্ষ্যংছড়িতে ছয়টি, আলীকদমে দুটি, থানচি ও রুমায় একটি করে ইটভাটা আছে।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে এবং চুল্লির আগুন পানি দিয়ে নিভিয়ে দেয়। অভিযান শেষে আবার এসব চুল্লি জ্বালানো হয়। স্থায়ীভাবে একটি ইটভাটাও বন্ধ করতে পারেনি প্রশাসন।
তাদের অভিযোগ, ইটভাটার মালিকরা প্রশাসনকে 'ম্যানেজ করে' এসব চালাচ্ছে।
২০১০ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও ২০১৩ সালের ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইনে বলা হয়েছে, বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা করা যাবে না। কৃষিজমিতেও ইটভাটা অবৈধ। অথচ বান্দরবানে সব ইটভাটায় পাহাড়ের পাদদেশে। পাহাড় কেটে, পরিবেশ ধ্বংস করে এগুলো চলছে।
উপজেলা প্রশাসন বলছে, অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। কিন্তু, নানান সীমাবদ্ধতার কারণেই জরিমানা ও চুল্লিতে পানি দিয়ে নেভানো ছাড়া আর কিছু তারা করতে পারছে না।
উপজেলা পর্যায়ে ইটভাটার চুল্লি ভাঙার মতো এস্কাভেটর নেই জানিয়ে প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হয়, বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে এসব যন্ত্রপাতির সরবরাহ পেলে অবৈধ সব ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া যেত।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরী দেশের সব অবৈধ ইটভাটা চার সপ্তাহের মধ্যে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সব বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিকে এ আদেশ বাস্তবায়ন করে ১৭ মার্চ প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।
পাশাপাশি অবৈধ ইটভাটা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং পাঁচজন বিভাগীয় কমিশনারকে ১৭ মার্চ সশরীরে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তারপরও প্রশাসনে অবৈধ ইটভাটা ভাঙার ক্ষেত্রে তৎপরতা দেখা যায়নি।
লামা ইটভাটা সমিতির সভাপতি মুক্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিগত সরকার থাকতে সবাইকে ম্যানেজ করে ইটভাটা করে এসেছি। এখন যেসব ইটভাটা করা হয়েছে, সেগুলো বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে। শ্রমিকদের অগ্রিম টাকা দিয়ে দেওয়ায় না করে উপায় ছিল না।'
বান্দরবান পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কয়টি ইটভাটা আছে, সব অবৈধ। এর কোনোটিরই লাইসেন্স নেই। তাছাড়া পাহাড় কেটে, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে এগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব ভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় বনের গাছ। ফলে এসব ইটভাটা পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতিসাধন করে চলেছে।'
তিনি বলেন, 'পুরো জেলায় আমাদের জনবল মাত্র দুজন। পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট নেই। এমনকি বড় এস্কাভেটরও নেই, যেগুলো দিয়ে চুল্লিগুলো ভেঙে দেওয়া যায়। এ কারণেই শুধু জমিরানা, আর পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে চলে আসা ছাড়া আমাদের কিছু করার থাকে না। সেই সুযোগ নিয়ে ভাটার মালিকেরা আবারও চুল্লি চালু করে।'
বান্দরবান জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, 'অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আইন মেনে অভিযান চলমান থাকবে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযান চলমান আছে।'
Comments