দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: মেসের খাবারে বাদ পড়ছে মাছ-মাংস, অর্ধেক হচ্ছে ডিম

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে রাজধানীর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অবস্থাই যেখানে নাভিশ্বাস ছোটার মতো, সেখানে মেসগুলোর অবস্থা বলাই বাহুল্য। এটা আরও প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে তাদের প্রতিদিনকার খাদ্য তালিকায়।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কমেছে মেসের খাবারের মান। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে রাজধানীর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর অবস্থাই যেখানে নাভিশ্বাস ছোটার মতো, সেখানে মেসগুলোর অবস্থা বলাই বাহুল্য। এটা আরও প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে তাদের প্রতিদিনকার খাদ্য তালিকায়।

রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় খবর নিয়ে জানা যায়, ডিম, পেঁয়াজ, শাক-সবজির মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেকখানি বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি মেসগুলোতে খুবই নিম্নমানের খাবার দেওয়া হচ্ছে।

বাংলামোটরের কমিশনার গলিতে একটি মেস পরিচালনা করেন মালেকা বেগম (৫০)। মেসের ২৫ সদস্যের জন্য দুপুর ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করেন। মেসের বেশিরভাগ সদস্যই স্বল্প আয়ের।

মালেকা বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মেসের সদস্যরা প্রত্যেককে প্রতি মাসে ২ হাজার ২০০ টাকা করে দেয়। গত বছর ২ হাজার টাকা করে নেওয়া হতো। জিনিসপত্রের দাম প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। তাই এখন ২০০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে।'

'আগামী মাস থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে নেওয়া হবে বলে তাদের জানিয়েছি। এ কথা শুনে অনেকেই মেস পরিবর্তন করার কথা চিন্তা করছে,' বলেন তিনি।

মেসের খাদ্য তালিকায় কী থাকে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আগে ২ হাজার টাকাতেই দুপুরে মাছ, রাতে ব্রয়লার মুরগি বা ডিম খাওয়াতে পারতাম। এখন পারি না। ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাদ দিয়েছি। ভালো মাছ দিতে পারি না। তবে পাঙ্গাস বা তেলাপিয়া মাছ খাওয়াতে পারি। কিন্তু মাছের আকারও দিন দিন ছোট করতে হচ্ছে।'

'রাতে শুধু একটা সবজি অথবা ভর্তা দিতে পারি। আগে ডাল খাওয়াতাম। এখন তাও দিতে পারি না,' যোগ করেন তিনি।

মালেকা বেগম সাধারণত কারওয়ান বাজার থেকে এক দিন পরপর বাজার করেন। তার সঙ্গে বাজারে গিয়ে দেখা যায়, তিনি খুবই নিম্নমানের সবজি, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি কিনছেন।

২০ টাকা কেজি দরে তাকে খোসা ছাড়ানো পেঁয়াজ কিনতে দেখা যায়। দোকানদার জানান, এগুলো ছিল ভেজা পেঁয়াজ। সাধারণ ক্রেতারা এগুলো কেনেন না। ফুটপাতের হোটেল কিংবা মেসের জন্য এসব ভেজা পেঁয়াজ কেনা হয়। এগুলোর খোসার পচা অংশ ছাড়িয়ে বিক্রি করা হয়।

মালেকা বেগমকে দেখা গেল কাটা বেগুন, আলু এবং ভাঙা ফুলকপি কিনতে। এগুলোর একাংশ পচা বা নষ্ট হওয়ায় দোকানদাররা ওই অংশ ফেলে দিয়ে বিক্রি করেন।

এসব কাটা সবজি ১০ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয় বলে দোকানদাররা জানান।

মালেকা বেগম বলেন, 'বাজার করার সময় প্রতিদিনই চেষ্টা থাকে আগের দিনের চেয়ে একটু কম দামে কেনা যায় কি না। খাবারের মান নিয়ে ভাবি না। খাওয়ার সময় প্রায় প্রতিদিনই মেসের সদস্যদের সঙ্গে ঝগড়া হয়।'

পশ্চিম কারওয়ান বাজারে ৩০ জন সদস্যের একটি মেস চালান শাহীনুর বেগম (৪৮)। দুপুর ও রাতের খাবার বাবদ সদস্যদের কাছ থেকে তিনি প্রতিদিন ১০০ টাকা করে নেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি প্রায় ১৫ বছর ধরে মানুষদের খাওয়াই। আগে মাসিক হারে টাকা নিতাম। কিন্তু এখন প্রতিদিন খাবারের টাকা প্রতিদিন নেই। কারণ মাস চালাতে যে পুঁজির প্রয়োজন, সেটা এখন আর নেই আমার।'

'দ্রব্যমূল্য যেভাবে বেড়েছে, তাতে খাবারের দাম বাড়ালেও পোষাতে পারছি না। গত ১ বছরে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ঋণ হয়ে গেছে,' বলেন তিনি।

তিনি জানান, দুপুরে ও রাতে তিনি মাছ কিংবা ডিম রান্না করেন। দুপুরে একটি সবজি বা ডাল থাকে।

শাহীনুর বলেন, 'আগে একজনের জন্য একটা ডিম দিতে পারতাম। এখন একটা ডিম দুইজনকে খাওয়াই। মাছ-মাংস তেমন দিতে পারি না। মাছ দিলেও আকার ছোটো করতে হয়।'

'জিনিসপত্রের দাম এভাবে বাড়লে মনে হয় না আর মেস চালাতে পারব,' যোগ করেন তিনি।

রাজধানীর মিরপুর কাজীপাড়ার একটি বাসায় নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করে আনিছুর রহমান (২৮)। এ কাজে তিনি মাসিক বেতন পান ৮ হাজার টাকা।

আনিছুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি পাশের একটি মেসে খাই। দুপুর ও রাতে দুই বেলা খাওয়ার জন্য আমাকে মাসে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। আবার সকালে নিজ খরচে নাস্তা করি। এতে কমপক্ষে ১ হাজার টাকা খরচ হয় মাসে।'

'এই বেতন দিয়ে কীভাবে আমি নিজে চলব, আর কীভাবে আমার পরিবার চলবে? বাড়িতে স্ত্রী আছেন, মা আছেন। তাদের জন্য মাসে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকার বেশি পাঠাতে পারি না,' বলেন তিনি।

আনিছুর বলেন, 'গত কয়েকমাসে মেসের খাবারের মান খুবই খারাপ হয়েছে। পচা-নষ্ট শাকসবজি, মাছ খাওয়ানো হয়। এসব খাবার খেতে কষ্ট হলেও, আর কোনো উপায় নেই। হোটেলে খাবার খরচ ইদানিং দ্বিগুণ হয়ে গেছে।'

'আর একটু ভালো খেতে চাইলে, বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারব না,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Ban on plastic bags a boon for eco-friendly sacks

Availability of raw materials now a challenge

8h ago