‘মাছ-গোশতো দূরের কথা এ্যালা ডিমাও হামার কপালোত জোটে না’

৫ জনের সংসারে তিনি একমাত্র উপার্জনকারী। দিনমজুরি করে প্রতিদিন ৪০০ টাকা উপার্জন করেন। মাঝে মাঝে কাজও থাকে না। প্রতিদিন আড়াই কেজি চাল লাগে তাদের। খাবার জোগাড় করতেই আয়ের টাকা শেষ হয়। কাজ না থাকলে অর্ধাহারে থাকেন পরিবারের সবাই। কখনো আবার করতে হয় ধার। তবুও মেটে না সংসারের চাহিদা।
জয়নব বেগম রান্না করছেন। পাশে তার স্বামী আজগর আলী। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

বাড়ির উঠানে চুলার ওপর কড়াই বসিয়ে আলুর তরকারি রান্না করছেন জয়নব বেগম। চুলার পাশে নির্বাক বসে আছেন তার স্বামী আজগর আলী। সকালে চুলায় হাঁড়ি উঠেনি। তাই কতক্ষণে রান্না শেষ হবে সেই অপেক্ষা তার।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গোড়কমন্ডল এলাকার দিনমজুর আজগর আলী। তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে খানিকটা বিরক্ত হন। কেমন আছেন জানতে চাইলে খানিকটা নীরব থেকে বলেন, 'ভালো নাই। হামারগুলার কপাল থাকি সুখ চলি গ্যাইছে। এ্যালা বাঁচি আছি কোনোমতে। জীবনটা চলি গ্যেইলে হামরাগুলা বাঁচোং।'

আজগর জানান, ৫ জনের সংসারে তিনি একমাত্র উপার্জনকারী। দিনমজুরি করে প্রতিদিন ৪০০ টাকা উপার্জন করেন। মাঝে মাঝে কাজও থাকে না। প্রতিদিন আড়াই কেজি চাল লাগে তাদের। খাবার জোগাড় করতেই আয়ের টাকা শেষ হয়। কাজ না থাকলে অর্ধাহারে থাকেন পরিবারের সবাই। কখনো আবার করতে হয় ধার। তবুও মেটে না সংসারের চাহিদা।

'ম্যালা দিন থাকি মাছ-গোশতো মুখোত জোটে না। ছওয়াগুলা মাছ-গোশতো খাবার চায়। মোর তো আর সাধ্য নাই। কোটে থাকি টাকা যোগার করিম। মাছ-গোশতো দূরের কথা এ্যালা ডিমাও হামার কপালোত জোটে না। গেল ৩০-৩৫ বছরেও হামরাগুলা এ্যাদোন কষ্টোত পড়োং নাই', বলেন তিনি।

আজগর আলীর স্ত্রী জয়নব বলেন, 'প্যাটের ভাতটাও ঠিকঠাক জুইটবার নাইকছে না। মাছ-গোশতো এ্যালা কোটে থাকি পাই। কয়দিন আগোত তাও ডিম খাইছিলোং, এ্যালাতো ডিমও যোগবার পাবার নাইকছি না।'

তিনি বলেন, 'প্রতিদিন আলুর তরকারি আর ডাল দিয়া ভাত খাওয়া নাইকবার নাইকছে। মাঝে মাঝে এ্যালা শুটকার ভর্তা আর তরকারি পাক করি। সপ্তাহে একদিনও গাত সাবান দিবার পাবার নাইকছি না। সাবানের যে দাম। সাবান কিনবার গ্যাইলে চাইল-ডাইল আর কেনা হবার নয়।'

'হামরাগুলা খুব কষ্টোত আছি। মাঝে মাঝে উপবাসও থাকা নাগে', যোগ করেন তিনি।

আধা কেজি চাল পাতিলে দিয়ে বাড়ির উঠানে রান্না করছেন সোনাভান বেওয়া (৬৭)। পাতিলে কয়েকটা আলুও দিয়েছেন ভর্তা করতে। আর কোনো তরকারি রান্না হবে না। চুলার পাশে অপেক্ষায় তার ক্ষুধার্ত নাতি রাশেদুল ইসলাম (১১)।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পশ্চিম সাতভিটা গ্রামের সোনাভান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঘরোত কিছুই নাই। নাতিটা প্যাটের ভোগোত ছটফট কইরবার নাকছিলো। মাইনসের কাছোত আধা কেজি চাইল আর কয়টা আলু কর্জা করি আইনছোং। ভাত আন্দি মুইও চাইট্টা খাইম, নাতিটাকও চাইট্টা দেইম।'

তিনি বলেন, 'বাজারোত জিনিসপাতির যে দাম, তাতে হামারগুলার বাঁচি থাকা খুব কষ্ট হইছে। মোর ব্যাটাটা এ্যাকলায় যেইকনা কামাই করে তাক দিয়া সংসার চলে না। মাছ-গোশতো তো হামারগুলার কপাল থাকি উঠি গ্যাইছে। এ্যালা ডিমাও হামার কপালোত জোটে না।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাট গ্রামের রিকশাচালক মফিজ উদ্দিন ডেইলি স্টারকে জানান, যে আয় হয় তাতে কোনো রকমে সংসার চলছে। কোনো সঞ্চয় নেই তার। বিপদে পড়লে ঋণ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

মফিজ বলেন, 'ছওয়াপোয়ার নেখাপড়ার খরচও বাড়ি গ্যাইছে। ঠিকমতো কাপড়চোপড়ও কেনা যাবার নাইকছে না। হাটোত গ্যাইলে মাছ-গোশতো হাটির যাবার সাহস পাং না। মাঝে মাঝে গ্যাইলেও মাছ আর গোশতো কেনা হয়। মুই শুধু চ্যায়া চ্যায়া দ্যাখোং।'

গতকাল মঙ্গলবার লালমনিরহাটের কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, রকমভেদে প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪-৬০ টাকা দরে, প্রতি কেজি গরুর মাংস ৭০০-৭৫০ টাকা দরে, প্রতি কেজি খাসির মাংস ৮৫০-৯০০ টাকা দরে, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২৬০-২৮০ টাকা দরে, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির চামড়া ছাড়ানো মাংস ৩৬০-৩৭০ টাকা দরে, প্রতি কেজি দেশি মুরগি ৩৮০-৪০০ টাকা দরে, প্রতি কেজি দেশি মুরগির চামড়া ছাড়ানো মাংস ৭০০-৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

এ ছাড়া সবজিভেদে কেজিপ্রতি দাম ১০-৮০ টাকা, শাকভেদে ১৫-৬০ টাকা। প্রতি হালি মুরগি ডিম ৪০-৪৪ টাকা, হাঁসের ডিম ৫৬-৬০ ও দেশি মুরগির ডিম ৫৬-৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ সবকিছুর দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় মানুষ খুব কষ্টে আছেন। এ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকায় শ্রমিকরা নিয়মিত কাজও পান না।'

তিনি আরও বলেন, 'যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, তারা রয়েছেন চরম বিপাকে। তাদের আয় বাড়েনি, বরং কর্মী ছাঁটাইয়ের আতঙ্ক নিয়ে তাদেরকে কাজ করতে হচ্ছে। আমার কাছে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সাহায্যের জন্য আসছেন। কিন্তু সীমিত সুযোগ থাকায় সবাইকে সাহায্য করতে পারছি না। মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের মানুষও দেখা করছেন, সাহায্য চাচ্ছেন।'

 

Comments