কেবল ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে কি বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?

‘এখানে কাঠামোগত সমস্যাটাই সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই কেবল ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম দিয়ে কোনোকিছু তো হবে না। কারণ দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই ব্যবসায়ী।’

চলতি মাসের শুরুর সপ্তাহেই পবিত্র রমজান মাসে মূল্যবৃদ্ধি রোধে পণ্য মজুতের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাজার মনিটরিং জোরদারের জন্য সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকের প্রতি নির্দেশ এসেছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (পিএমও) থেকে।

কিন্তু সেই নির্দেশনা কাজে আসেনি। এমনিতেই প্রতিবছর রমজান মাসকে ঘিরে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। কিন্তু এবার আগে থেকেই বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে, যা তেতে থাকা বাজারকে আরও বেশি উত্তপ্ত করে তুলেছে। আর সেই আগুনে পুড়ে চলেছেন সাধারণ ক্রেতারা।

এমন পরিস্থিতিতে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার খবর আসছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে—কেবল ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করে কিংবা কারাদণ্ড দিয়ে কি মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের সঙ্গে।

শাহদীন মালিক মনে করেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম হয়তো সাময়িক কিছু সাফল্য আনতে পারে। কিন্তু এভাবে দীর্ঘমেয়াদী কোনো সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব না।

এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর ভাষ্য, '(ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে) দীর্ঘমেয়াদে কোনো কিছু হবে না। কারণ এই সংসদের নির্বাচিত ৩০০ সদস্যের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই ব্যবসায়ী। যারা এই বাজারটা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা সারাজীবন ব্যবসার মাধ্যমে তাদের ‍মুনাফা-আয় বাড়ানোর চেষ্টা করে এসেছেন। এখন তাদের ওপর যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় অন্য লোকের আয় ও মুনাফা কমিয়ে আনার, তাহলে তো তা সাংঘর্ষিক হবে।'

শাহদীন মালিক বলেন, 'বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় ব্যবসায়ীদের দিয়ে এ জন্যই সংসদ ভরিয়ে ফেলে না। কারণ বাজারটা তখন সরকারের নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা থাকলেও তা কার্যকর হয় না। এখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব চলে আসে। যে মানুষ সারাজীবন তার মুনাফা যতটাসম্ভব বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাকে যদি দাম বাড়ানো-কমানোর বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে দেওয়া হয়, সেটা তো কখনোই সম্ভব না।'

এখানে কাঠামোগত সমস্যাটিকেই সবচেয়ে বড় করে দেখতে চান এই আইনজীবী। তিনি বলেন, 'এখানে কাঠামোগত সমস্যাটাই সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই কেবল ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম দিয়ে কোনোকিছু তো হবে না। কারণ দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই ব্যবসায়ী।'

শাহদীন মালিক আরও বলেন, 'টেলিভিশনে খবর দেখি। যে বিজ্ঞাপনগুলো দেখানো হয় তাতে ঘুরেফিরে দশটা-বিশটা কোম্পানির বিজ্ঞাপন প্রত্যেকটা চ্যানেলে হচ্ছে। পুরো অর্থনীতির ওপর তাদের যে নিয়ন্ত্রণ এটা তারই সূচক। এই নিয়ন্ত্রণটা চ্যানেলগুলোর ওপরেই বটে। এখন যদি কোনো টিভি স্টেশনকে বলা হয় যে তাদের বিজ্ঞাপন দেবে না। তাহলে তো ওই টিভি স্টেশনের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।

'যারা সিন্ডিকেট করে তারাই এখন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী। এই কাঠামোগত সমস্যায় দাম নিয়ন্ত্রণ করা আসলেই সম্ভব হবে না।'

এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় কিছু ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দুর্ব্যাবহার ও 'ক্ষমতা দেখানোর' প্রবণতার বিষয়েও কথা হয় শাহদীন মালিকের সঙ্গে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'ভ্রাম্যামাণ আদালত তো অনেক অভিযান পরিচালনা করছে। অনেক জায়গায় যাচ্ছে। অনেককিছু পরীক্ষা করছে। শাস্তিও দিচ্ছে। এর বিপরীতে বিচ্ছিন্নভাবে বিচারিক নিয়মের লঙ্ঘন যারা করছেন সেটার সংখ্যা তো খুব কম।'

'এক্ষেত্রে প্রশাসনিকভাবে তাদের সতর্ক করাটা বোধহয় ঊর্ধ্বতনদের দায়িত্ব হবে। তারা অভিযুক্তদের কর্তব্য থেকে সরিয়ে নিতে পারে, তা না করলে অন্তত সতর্ক করতে পারে, জনগণের সঙ্গে তাদের আচরণ কেমন হবে সে ব্যাপারে বলতে পারে। ক্ষমতা দেখানো থেকে তারা যাতে নিবৃত্ত থাকে সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে পারে।'

বিষয়টি নিয়ে আলী ইমাম মজুমদারের বক্তব্যও একই রকম। তিনি বলেন, 'ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম অবশ্যই আইনানুগ হওয়া উচিত। সমাজের প্রয়োজনেই এই ব্যবস্থাটা চালু আছে। এখানে বাড়াবাড়ির সুযোগ কোনো পক্ষেরই নেই।

'আবার মোবাইল কোর্ট কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় আইন প্রয়োগ করেও আক্রান্তও হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তির সমর্থনে এটা ঘটছে। আমি আশা করব সবাই আইন অনুসারে সংযতভাবে কাজ করবেন। আইনানুগ দায়িত্ব পালন করবেন। নাগরিকরা সহায়তা করবেন। অন্য যারা আছেন তারাও সকলে সহায়তা করবেন।'

আলী ইমাম মজুমদার আরও বলেন, 'শুধুমাত্র ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এর সঙ্গে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে আরও বহুকিছু আছে।'

এই সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ভাষ্য, 'মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমরা সবাই সাফারার। আগের কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক সাহেব বলেছিলেন, প্রতি কেজি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ২২ থেকে ২৩ টাকা। এখানে এক্সপ্লয়টারদের হাত কতটা দৃঢ় যে, বলা হচ্ছে দাম কমেছে—তাও সেই পেঁয়াজ আমাদের ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এটা তো আমাদের লোকাল প্রোডাক্ট। আমরা ইমপোর্ট করছি না।'

তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে 'ক্ষেত্রবিশেষে' ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, 'এখানে মার্কেট মেকানিজম নিয়েও কাজ করতে হবে, পলিসি লেভেল থেকে দেখতে হবে, সেইসঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গীকারও থাকতে হবে।'

দেশি কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সরকারের পক্ষ থেকে কেবল আমদানি সিদ্ধান্ত নিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না বলেও মন্তব্য করেন আলী ইমাম মজুমদার। বলেন, 'দাম বৃদ্ধির কারণে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করে। বড় রকমের ভূমিকা রাখতে পারে না। কিন্তু ভেজাল খাবার, পঁচা বাসি খাবার- এসব ক্ষেত্রে তারা রিমার্কেবল কাজ করেছে। সবক্ষেত্রে তো তারা পারবেও না।'

Comments