কেন শিকাগোর বাজারের খোঁজ রাখেন মৌলভীবাজারের পাইকার?

রাজধানীর এই ঘিঞ্জি এলাকায় অনেক চায়ের দোকানে আড্ডা হয় লন্ডন কমোডিটি এক্সচেঞ্জ, শিকাগো বোর্ড অব ট্রেড ও বুরসা মালয়েশিয়ায় পণ্যের দামের ওঠানামাকে ঘিরে।
পাইকার
ছবি: স্টার

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের সরু রাস্তা। রাস্তার পাশে ছোট ছোট দোকানগুলোয় পণ্য কেনাবেচার কর্মচাঞ্চল্য। মোবাইল ফোনে পাইকাররা খোঁজ নিচ্ছেন বিশ্ব বাজারে চিনি ও ভোজ্য তেলের দাম। চোখ রাখছেন শিকাগো ও লন্ডনের মতো ট্রেডিং ফ্লোরের সংবাদে।

রাজধানীর এই ঘিঞ্জি এলাকায় অনেক চায়ের দোকানে আড্ডা হয় লন্ডন কমোডিটি এক্সচেঞ্জ, শিকাগো বোর্ড অব ট্রেড ও বুরসা মালয়েশিয়ায় পণ্যের দামের ওঠানামাকে ঘিরে।

আন্তর্জাতিক বাজারে চিনি ও ভোজ্য তেলের উৎপাদন, দাম, এমনকি, আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়েও চলে প্রাণবন্ত আড্ডা। এত উৎসাহের কারণ হলো, তারা আমদানি পণ্যের 'সরবরাহ আদেশ' বা সাপ্লাই অর্ডার (এসও) কিনতে চান।

কারখানার মালিক ও পাইকারদের এই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য নিয়ে আজকের এই আয়োজন।

ছবি: রাজীব রায়হান

পাইকাররা চিনি বা ভোজ্য তেলের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্য 'এসও স্লিপ' নিয়ে কেনাবেচা করেন। বেশি লাভের আশায় 'এসও' কিনলেও বিশ্ব বাজারে দাম কমে গেলে তাদের লোকসান গুণতে হয়।

যেমন—পাইকাররা 'এসও'র মাধ্যমে পণ্য আগাম কিনতে যে টাকা কারখানা বা আমদানিকারককে দেন, হাতে পাওয়ার পর পণ্যের দাম কমে গেলে তাদের লোকসান হয়।

বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও ভোজ্যতেল পাইকারি বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাইকাররা নিজেদের মধ্যে মুনাফা রেখে পণ্যের "এসও" অন্যদের কাছে বিক্রি করেন। তবে সেই মুনাফার হার কম।'

তারা যদি মনে করেন যে বিশ্ব বাজারে একটি পণ্যের দাম বাড়বে তখন তারা সেই পণ্যের 'এসও' কিনেন। বেশি মুনাফার আশায় একজনের কাছ থেকে পণ্যের 'এসও' আরেকজন কেনেন বলে সাধারণত স্থানীয় বাজারে সেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়, বলে কারো কারো অভিযোগ। তবে এর বিপরীতেও অনেক যুক্তি আছে। যেসব পণ্যের এসও বিক্রি হয় না, সেগুলোরও দাম বাড়ে।

তাছাড়াও, 'এসও' বিক্রির কারণে পণ্যের কারসাজির সুযোগ কমে যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পাইকার 'এসও' ব্যবসা করেন। একটি 'এসও'র মাধ্যমে ২২ লাখ টাকায় ১৬ টন চিনি অথবা সাড়ে সাত লাখ টাকায় ছয় টন ভোজ্যতেল কেনা যায়।

আবুল হাশেম জানান, সাধারণত 'এসও' কেনার ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য হাতে নিতে হয়। বাস্তবে দেখা যায় নির্ধারিত সময়ের দুই মাস পর 'এসও' ক্রেতা পণ্য নিতে আসেন।

প্রায় ২০ বছর ধরে এ ব্যবসায় থাকা ইকবাল হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পণ্যের দাম ভবিষ্যতে কোথায় দাঁড়াবে তা বুঝতে আন্তর্জাতিক বাজারে চোখ রাখি। অনুমান সঠিক হলে ব্যবসায় মুনাফা হয়। মাঝেমধ্যে অনুমান ব্যর্থ হয়। বিশ্ব বাজারে আমার কেনা পণ্যের দাম পড়ে গেলে লোকসানে পড়ি।'

ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কতটা কমবে অনেকে তা অনুমান করতে পারেন না বলেও লোকসানে পড়েন। গত দুই বছরে টাকার দাম কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ।

২০১১ সালে ডেলিভারি অর্ডারের (ডিও) পরিবর্তে 'এসও' ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি দেশে শোধনাগার হওয়ায় তখন থেকে প্রচুর পরিমাণে ভোজ্য তেল ও চিনি আমদানি শুরু হয়। সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিতরণ ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ-২০১১ প্রণয়ণের পর 'ডিও' ব্যবস্থা উঠে যায়।

যেহেতু কারখানাগুলোর কার্যকরী মূলধনের প্রয়োজন, তাই তারা পাইকারদের কাছে 'ডিও' বিক্রি করতেন। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো পাম অয়েল আমদানি শুরু করলে মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী আফসার উদ্দিন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ব্যবসা শুরু করেন। সেই সময় এই ব্যবসা নির্ভর করতো পণ্য কেনার রশিদের ওপর।

জাহাজে পণ্য আনার সময়ই পাইকাররা তা কেনার রসিদটি আমদানিকারকদের কাছ থেকে কিনে নিতেন। জাহাজ দেশে পৌঁছার আগেই এই রশিদ বেশ কয়েকবার কেনাবেচা হতো। জাহাজ নোঙর করলে রশিদ দেখিয়ে পাইকাররা পণ্য সংগ্রহ করতেন। এরপর, তারা তা ছাড়তেন পাইকারি বাজারে।

দেশের অন্যতম শীর্ষ আমদানিকারক ও পণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক (ফিন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) শফিউল আতহার তসলিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিলারদের পণ্য দেওয়ার জন্য ডিও ব্যবস্থায় কোনো সময়সীমা উল্লেখ ছিল না।'

'তবে এসও ব্যবস্থায় ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে' জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য নিয়ে যাওয়ার এই নিয়ম সরবরাহ ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে।'

তার দাবি, 'এসও' ব্যবসার কারণে ক্রেতা পর্যায়ে দাম বাড়ার সুযোগ নেই। দিন শেষে এর মাধ্যমে ক্রেতারাই উপকৃত হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এমএ তসলিম মনে করছেন, 'এসও-ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা ভালো কাজ করছে।'

তিনি বলেন, 'বিশ্ব বাজারে পণ্যের দাম নেমে যাওয়ার কারণে দেশের পাইকারদের লোকসান হলেও আমরা কারো কাছ থেকে অভিযোগ শুনিনি। তারা জানেন এখানে লোকসানের ঝুঁকি আছে।'

অধ্যাপক তসলিম আরও বলেন, 'এসও কেনার দীর্ঘদিন পর কারখানা থেকে পণ্য খালাস করলেও পাইকারদের সম্মান দেওয়া হয়। বলা যেতে পারে, এটি তাদের দৃষ্টিতে আনুষ্ঠানিক বাজার। এটি বহু দশক ধরে চলে আসছে। এই পদ্ধতি নিয়ে এখনো এমন সংবাদ পাওয়া যায়নি যে কেউ 'এসও' নিয়ে হাজির হয়েছেন কিন্তু কারখানা তাকে পণ্য দিচ্ছে না। সুতরাং এই ব্যবস্থা ভালোই কাজ করছে।'

তার মতে, পণ্য বিক্রির নতুন ব্যবস্থা আনার পরিবর্তে সরকার 'এসও'কে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে পারে।

Comments