বেহাল দশায় ২৫ সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সেবা

প্রতীকী ছবি

জনবলের অভাবে দেশের ২৫টি সরকারি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) অকার্যকর বা আংশিকভাবে চলছে। এর ফলে গুরুতর অসুস্থ রোগীরা জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ২০২০ সাল থেকে গত বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পের আওতায় ২২টি জেলায় মোট ২৪০টি আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়েছিল।

এই ইউনিটগুলো পরিচালনার জন্য মেডিকেল অফিসার এবং টেকনিশিয়ানসহ ১ হাজারেরও বেশি কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তবে তাদের চুক্তির মেয়াদ গত বছরের ডিসেম্বরে শেষ হয়ে গেছে এবং সরকার তাদের পুনর্নিয়োগ বা বিকল্প কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি।

এর ফলে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সুবিধার ওপর চাপ বেড়েছে, এবং অনেক রোগীর জন্য জরুরি সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আইসিইউ সেবার অতিরিক্ত খরচ বেশিরভাগ রোগীর সাধ্যের বাইরে।

সম্প্রতি কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় জরুরি চিকিৎসা সেবা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে আইসিইউ সেবার চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশের ৪২টি জেলার ৭৪টি সরকারি হাসপাতালে বর্তমানে মোট ১ হাজার ৩৭২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। অর্থাৎ ২২টি জেলায় এখনো কোনো আইসিইউ সুবিধা নেই। এছাড়া এসব শয্যার মধ্যে ৭৫৮টি (৫৫ শতাংশ) ঢাকাভিত্তিক ২২টি সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রীভূত।

ইআরপিপি প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালে কুমিল্লা, নোয়াখালী, গোপালগঞ্জ, ফেনী, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, শেরপুর, টাঙ্গাইল, যশোর, সুনামগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, বাগেরহাট এবং মাদারীপুর জেলায় ১৩টি সরকারি হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছিল।

একই প্রকল্পের আওতায় ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং খুলনা, দিনাজপুর, বরিশাল, সিলেট, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, বগুড়া ও কুমিল্লায় নয়টি মেডিকেল কলেজে আইসিইউ স্থাপন করা হয়।

এছাড়া ঢাকার সংক্রামক রোগ হাসপাতাল এবং চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস-এ পাঁচ শয্যার আইসিইউ চালু করা হয়েছিল।

দ্য ডেইলি স্টার ১১টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, জনবল সংকট এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে কমপক্ষে চারটি আইসিইউ সেবা চালু করা যায়নি। এগুলো হলো ২৫০ শয্যার যশোর জেনারেল হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

আরও ছয়টি হাসপাতাল আংশিকভাবে আইসিইউ পরিষেবা চালু রেখেছে। এগুলো হলো— গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকার ইনফেকশাস ডিজিজেস হাসপাতাল।

গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট জীবিতেশ বিশ্বাস বলেন, আমরা কোনোভাবে আইসিইউটি কার্যকর রেখেছি... তবে ঠিকমতো চালু বলা যাবে না।'

এ বছরের জানুয়ারিতে জনবল সংকটের কারণে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল তাদের আইসিইউ সেবা বন্ধ করে।

হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট আহমেদ কবির বলেন, আমরা এখন গুরুতর রোগীদের ঢাকার হাসপাতালে রেফার করি।'

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আরও ১৪টি হাসপাতালের আইসিইউও পুরোপুরি অচল বা আংশিকভাবে চালু আছে।

ইআরপিপি প্রকল্প

২০২০ সালের এপ্রিল মাসে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর এক মাস পর মহামারির প্রতিক্রিয়ায় স্বাস্থ্যখাতকে শক্তিশালী করতে সরকার 'কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপারেডনেস' (ইআরপিপি) প্রকল্প চালু করে। শুরুতে এর জন্য ১ হাজার ১২৭ দশমিক ৫১ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখা হয়।

২০২১ সালের জানুয়ারিতে সংশোধনের পর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত এই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৬ হাজার ৭৮৬ দশমিক ৫৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয় কারণ এতে আরও কয়েকটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছিল। তবে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে আরেকটি সংশোধনীর পর ব্যয় ৬ হাজার ৩৮৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকায় নেমে আসে।

সরকার প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের অধীনে ৩৯৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করেছিল। পরে কর্মী সংখ্যা ১ হাজার ১৫৪ জনে উন্নীত করা হয়, যার মধ্যে মেডিকেল অফিসার, নার্স এবং টেকনোলজিস্টও ছিলেন।

গত বছরের ডিসেম্বরে তাদের চাকরির চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মৌখিকভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন এবং পরে বেতন দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। অধিদপ্তরের সূত্র অনুসারে, অনেকেই সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে কাজ চালিয়ে যান।

তবে মে মাসের শেষের দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তাদের সেবা বন্ধ করে দিতে বলেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, জানুয়ারি থেকেই অনেক হাসপাতালে আইসিইউ সেবা ব্যাহত হতে শুরু করে। তবে কিছু হাসপাতাল নিজেদের বিদ্যমান জনবল থেকে কর্মী নিয়োগ করে জরুরি সেবা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পাশাপাশি, প্রকল্পের আওতায় কর্মরত কিছু স্বাস্থ্যকর্মীও দায়িত্ব পালন চালিয়ে যান।

বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা

স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর এবং প্রকল্প কর্মকর্তাদের মতে চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে বিশ্বব্যাংক অস্বীকৃতি জানানোয় প্রকল্পের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে।

প্রকল্পের আওতায় সরকার আরও ৩৩টি জেলা হাসপাতালে ১০ শয্যা বিশিষ্ট আইসিইউ, ১৬টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশুদের জন্য আইসিইউ, ১৫টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে থাকা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য প্রসূতি আইসিইউ, দুটি বিশেষায়িত হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ এবং ২১টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ জরুরি পরিষেবা কেন্দ্র স্থাপন করার কথা ছিল।

এর মধ্যে ১৯টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরি স্থাপন; ৩০টি হাসপাতালে লিকুইড মেডিকেল অক্সিজেন সিস্টেম স্থাপন বা সম্প্রসারণ এবং ২০টি হাসপাতালে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট স্থাপন এবং বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরে মেডিকেল স্ক্রিনিং সুবিধা স্থাপনের মতো অন্যান্য সুবিধা চালু করার লক্ষ্য ছিল।

কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে, কিন্তু যন্ত্রপাতি কেনা ও জনবল নিয়োগ নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে।

এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রস্তাব করেছিল, পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) তিনটি পরিকল্পনার মাধ্যমে অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করা হবে। একইসঙ্গে এই প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদেরও ওই পরিকল্পনার অধীনে রাখা হবে।

তবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রস্তাবিত পঞ্চম এইচপিএনএসপি বাতিল করে এবং সমন্বয় বাড়াতে ও অবকাঠামো শক্তিশালী করতে স্বাস্থ্য কর্মসূচিগুলোকে নিয়মিত কর্মসূচির সাথে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

জুনের প্রথম সপ্তাহে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি বৈঠক করেছে। সেখানে দুটি বিকল্প নিয়ে আলোচনা হয়: বাকি কাজ শেষ না করেই প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা, অথবা অসম্পূর্ণ কাজগুলো শেষ করার জন্য একটি নতুন প্রকল্প শুরু করা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) একজন কর্মকর্তা গত ২৮ জুন ডেইলি স্টারকে জানান, 'প্রকল্পের বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।'

তিনি আরও জানান, বাকি কাজ শেষ করতে কতটা অর্থ ও সময় লাগবে তা খতিয়ে দেখার জন্য প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সাঈদুর রহমান বলেন, জরুরি অবস্থার সময় আইসিইউগুলো তৈরি করা হয়েছিল, এবং পরবর্তীতে সেগুলোর অনেকগুলো অব্যবহৃতই থেকে গেছে।

তিনি জানান, সরকার একটি ক্লাস্টার সিস্টেম চালু করার পরিকল্পনা করছে। এর আওতায় একটি হাসপাতালের আইসিইউকে দুই থেকে তিনটি প্রতিবেশী জেলার রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য নির্ধারণ করা হবে। কারণ, সব আইসিইউতে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।

তিনি ডেইলি স্টার পত্রিকাকে জানান, 'এই নতুন ব্যবস্থায়, প্রতিটি এলাকার জন্য একটি নির্দিষ্ট হাসপাতালকে বেছে নেওয়া হবে এবং সেটার আইসিইউ পুরোপুরি চালু করা হবে। এরপর, অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে সেই আইসিইউকে আশেপাশের এক বা দুটি হাসপাতালের সাথে যুক্ত করা হবে। এর ফলে, যেসব রোগীর জরুরি আইসিইউ সেবা দরকার, তাদের ওই নির্বাচিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh smash 7 past Turkmenistan

Bangladesh team had reserved their celebration of clinching Asian Cup berth till the last match of the campaign. On Saturday, against Turkmenistan, they celebrated the epic achievement with a resounding 7-0 victory, ending the Asian Cup Qualifiers campaign with an all-win record at the Thuwunna Stadium in Yangon.

3h ago