সরকারি হাসপাতালে চালু হচ্ছে চিকিৎসা সরঞ্জামের ডিজিটাল মনিটরিং

সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম সচল আছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালুর উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
যন্ত্রপাতি বিকল থাকায় রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সেবা বিলম্ব হয়—রোগীদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে দেশের ১১৪টি সরকারি হাসপাতালের ৩০০টি চিকিৎসা সরঞ্জাম 'মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ইনফরমেশন অ্যান্ড মনিটরিং সিস্টেম' এর আওতায় আনা হবে।
ক্যানসারসহ গুরুতর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ সাত ধরনের সরঞ্জামকে নিয়মিত মনিটরিংয়ের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—এমআরআই, সিটি স্ক্যান, এক্স-রে ও রেডিওথেরাপি মেশিন, জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
রোগীদের দুর্ভোগ
উন্নত চিকিৎসার জন্য গত জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে পটুয়াখালী থেকে ঢাকায় আসেন ষাটোর্ধ্ব সাকিনা বেগম। ২৮ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) চিকিৎসকরা তাকে অবিলম্বে রেডিওথেরাপি নেওয়ার পরামর্শ দেন। দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালে তিনটি রেডিওথেরাপি মেশিনের মধ্যে দুটি বহু বছর ধরে অচল থাকায় তাকে প্রায় তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়।
'সবগুলো মেশিন চালু থাকলে আমার মা সময় মতো চিকিৎসা পেতেন,' সাকিনার ছেলে হাদিস খান সোমবার দ্য ডেইলি স্টারকে এ কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করেছিলাম, কারণ ওখানে হলে আমাদের জন্য সুবিধা হয়। কিন্তু জানতে পারলাম সেখানেও রেডিওথেরাপি মেশিন নষ্ট।'
রেডিওথেরাপির জন্য নারায়ণগঞ্জের পারভীন বেগমকেও (৫০) প্রায় ২৫ দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।
রেডিওথেরাপি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, একটি মেশিন সাত-আট বছর ধরে অকেজো এবং অন্যটি পাঁচ-ছয় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে চালু থাকা একমাত্র মেশিনটিও কয়েক মাস আগে মেরামত করা হয়েছে।
কেবল ঢামেক হাসপাতাল নয়, এ রকম শত শত অচল চিকিৎসা সরঞ্জামের কারণে সরকারি হাসপাতাল রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা দিতে সমস্যায় পড়ছে। ফলে অনেককে বাধ্য হয়ে ব্যয়বহুল বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হচ্ছে, জানান স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
প্রায় ৭০০ সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করার দায়িত্ব সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (এনইএমইএমডব্লিউ অ্যান্ড টিসি)।
সংস্থাটির কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রায় ৫০০টি চিকিৎসা সরঞ্জাম মেরামতের আবেদন জমা রয়েছে। এর মধ্যে উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রও রয়েছে। তবে অচল যন্ত্রপাতির প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ অনেক হাসপাতাল মেরামতের আবেদন করতে দেরি করে।
যোগাযোগ করা হলে এনইএমইএমডব্লিউ অ্যান্ড টিসির চিফ টেকনিক্যাল ম্যানেজার জয়ন্ত কুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ৪১৫টি চিকিৎসা সরঞ্জাম মেরামতের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে এবং বাকি যন্ত্রগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করতে পরিদর্শন চলছে।
পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় এই প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগছে, বলেন তিনি।
এনইএমইএমডব্লিউ অ্যান্ড টিসির ৯৫টি পদের মধ্যে অন্তত ৫৮টি শূন্য রয়েছে জানিয়ে জয়ন্ত আরও বলেন, ১৯ জন সহকারী প্রকৌশলীসহ মোট ৫৫ জন কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। আশা করছি, চলতি বছরই নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হবে।
ডিসেম্বর থেকে ডিজিটাল মনিটরিং
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গত ১৮ আগস্ট এনইএমইএমডব্লিউ অ্যান্ড টিসিকে চিঠি দিয়ে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সরঞ্জাম মনিটর করার একটি সিস্টেম প্রস্তুত করাতে নির্দেশ দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে) অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, এই সিস্টেম চালু হলে সরকারি হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
তিনি গত ২৩ আগস্ট ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা রিয়েল-টাইম আপডেট পাব…দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারব। কারণ যন্ত্রপাতি মেরামত না হওয়া পর্যন্ত সিস্টেম সতর্কবার্তা পাঠাতে থাকবে।'
জয়ন্ত কুমার বলেন, প্রথম পর্যায়ে দেশের সব জেলা ও বিশেষায়িত হাসপাতালসহ ১১৪টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নত প্রযুক্তির ব্যয়বহুল চিকিৎসা সরঞ্জাম পর্যবেক্ষণ করা হবে।
এসব সরঞ্জামের মূল্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হতে পারে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক ও আর্থিক অনুমোদন পাওয়ার পর একজন ভেন্ডর নিয়োগে টেন্ডার আহ্বান করা হবে। আশা করা হচ্ছে সিস্টেমটি ডিসেম্বরে চালু হবে, বলেন তিনি।
যেভাবে কাজ করবে এই সিস্টেম
এনইএমইএমডব্লিউ অ্যান্ড টিসির দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতিটি যন্ত্রের বিদ্যুৎ খরচ পর্যবেক্ষণের জন্য মনিটরিং ডিভাইস স্থাপন করা হবে।
প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে তারা বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় একটি যন্ত্র নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করে। ব্যবহারের সময় এর খরচ বেড়ে যায়। যন্ত্রটি অচল হয়ে পড়লে বিদ্যুৎ ব্যবহার প্রায় শূন্যে নেমে আসবে এবং সে সময় মনিটরিং ডিভাইসটি হাসপাতাল, এনইএমইএমডব্লিউ অ্যান্ড টিসি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সিস্টেমে সংকেত পাঠাবে।
তারা আরও জানান, পাশাপাশি এসব সরঞ্জামের স্থাপনের তারিখ, রক্ষণাবেক্ষণ ইতিহাস ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য সংরক্ষণ করা হবে।
Comments