অ্যান্টিবায়োটিক–প্রতিরোধী ‘সুপারবাগ’ ঠেকাতে নতুন ওষুধ আবিষ্কারের লড়াই

প্রতীকী ছবি | সংগৃহীত

আমাদের দেহে নানারকম ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীব বসবাস করে। কিছু উপকারী, কিছু অপকারী। অপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলো রোগ তৈরি করে। এ ধরনের রোগের চিকিৎসায় ডাক্তাররা অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দেন।

অ্যান্টিবায়োটিককে চিকিৎসা বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কারগুলোর একটি হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। অনেক রোগের চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। অ্যান্টিবায়োটিক–প্রতিরোধী এসব জীবাণুকে বলা হচ্ছে 'সুপারবাগ'।

চিকিৎসাবিষয়ক জার্নাল 'দ্য ল্যানসেট'-এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০২১ সালে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সুপারবাগের কারণে বিশ্বে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

'অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স'-এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর একটি দক্ষিণ এশিয়া। ল্যানসেটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে এই অঞ্চলে প্রতি এক লাখ মৃত্যুর মধ্যে ২২টির পিছনে সুপারবাগ দায়ী। কেবল ভারতেই ২০১৯ সালে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সংক্রমণের কারণে প্রায় তিন লাখ মানুষ মারা গেছেন। এর মধ্যে ৬০ হাজারই নবজাতক।

২০১৯ সালে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) আইসিইউতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ সুপারবাগ।

আশার সংবাদ হচ্ছে, এখন নতুন কিছু ওষুধ তৈরি হচ্ছে যারা এসব সুপারবাগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আলো দেখাচ্ছে। সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে সুপারবাগ ধ্বংস করতে পারে এমন নতুন কিছু ওষুধ আবিষ্কারের তথ্য উঠে এসেছে। 

ভারতীয় কোম্পানিগুলোর ওষুধ আবিষ্কারের প্রতিযোগিতা 

চেন্নাই-ভিত্তিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অর্কিড ফার্মা এমন এক অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করেছে যা ব্যাকটেরিয়াকে ঘায়েল না করে তার অ্যান্টিবায়োটিক-বিরোধী প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ঘায়েল করে। 'এনমেটাজোব্যাকটাম' নামের এই ওষুধ মূত্রনালির ইনফেকশন (ইউটিআই), নিউমোনিয়া এবং রক্তের সংক্রমণের মতো জটিল রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। 

বিশ্বের ১৯ দেশে এক হাজারেরও বেশি রোগীর ওপর এ ওষুধের পরীক্ষা চালিয়ে কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) ইতোমধ্যে এ ওষুধের অনুমোদন দিয়েছে।

মুম্বাই-ভিত্তিক ওষুধ কোম্পানি ওকহার্ড 'জাইনিচ' নামে একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে কাজ করছে। তাদের দাবি, এই ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সব ধরনের সুপারবাগের বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম।   

অন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না, এমন ৩০ জন গুরুতর রোগীকে এই ওষুধ সেবন করানো হয়েছে। এবং তাদের সবাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন।  

২৫ বছরের গবেষণায় তৈরি হওয়া এই ওষুধ বর্তমানে তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে রয়েছে। জাইনিচ আগামী বছর বাজারে আসতে পারে। 

নাফিথ্রোমাইসিন নামে ওকহার্ডের আরেকটি ওষুধ এখন তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে রয়েছে। ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া প্রতিরোধে এর সাফল্যের হার ৯৭ শতাংশ। এই রোগের বিদ্যমান চিকিৎসাগুলোর কার্যকারিতা ৬০ শতাংশের কম। 

অনুমোদন পেলে আগামী বছরের শেষ নাগাদ বাজারে আসতে পারে নাফিথ্রোমাইসিন। 

নতুন প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক

জেনেভা-ভিত্তিক গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ (জিএআরডিপি) বেঙ্গালুরুর বায়োফার্মা প্রতিষ্ঠান বাগওয়ার্কস রিসার্চের সঙ্গে যৌথভাবে নতুন প্রজন্মের কিছু অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করছে। যারা ওষুধ কাজ করে না এমন গুরুতর ইনফেকশন নিরাময় করতে সক্ষম। তাদের একটি অ্যান্টিবায়োটিক বর্তমানে প্রাথমিক ধাপের ট্রায়ালে রয়েছে, ওষুধটি বাজারে আসতে পাঁচ থেকে আট বছর সময় লাগতে পারে।

অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সুপারবাগে দক্ষিণ এশিয়ার বেহাল দশা বিবেচনায় জিএআরডিপি তাদের কর্মকাণ্ড ভারতকে কেন্দ্র করে পরিচালনা করছে। তারা হায়দরাবাদভিত্তিক অরিজিন ফার্মাসিউটিক্যাল সার্ভিসেসের সঙ্গে যৌথভাবে জোলিফ্লডাসিন নামে একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করছে, যা গনোরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত হবে। 

জাপানি কোম্পানি শিওনোগির সঙ্গে মিলে 'সেফিডেরোকল' নামে আরেকটি অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে আনতে যাচ্ছে জিএআরডিপি। মূত্রনালির ইনফেকশন ও নিউমোনিয়া চিকিৎসায় কার্যকরী এই ওষুধ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএর অনুমোদন পেয়েছে। ভারতের উৎপাদনের পাশাপাশি এ ওষুধ বিশ্বের ১৩৫টি দেশে সরবরাহের কথা রয়েছে।

নতুন এসব ওষুধ যেমন আশা দেখাচ্ছে, তেমনি এদের নিয়ে সতর্কও করে দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের দেহের অপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোর পাশাপাশি অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়াও ধ্বংস করে। এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, শরীরের অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যায়। এবং সবচেয়ে বড় বিষয়, শরীরের ব্যাকটেরিয়াগুলো এসব ওষুধ প্রতিরোধের উপায় বের করতে শুরু করে। 

চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. কামিনী ওয়ালিয়া বিবিসিকে বলেন, 'এসব নতুন ওষুধের সংবাদে আমি অবশ্যই উচ্ছ্বসিত। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আগের কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে যেভাবে অপব্যবহার করেছি আমরা, সেটা এবার যেন না হয়। অযথা এবং অসতর্কভাবে ব্যবহার করলে এই নতুন ওষুধগুলোও বেশি দিন কার্যকর থাকবে না।' 

 

Comments

The Daily Star  | English

Banks see sluggish deposit growth as high inflation weighs on savers

Banks have registered sluggish growth in deposits throughout the current fiscal year as elevated inflation and an economic slowdown have squeezed the scope for many to save, even though the interest rate has risen.

14h ago