ট্রাম্পের চাপ, নাকি অভ্যন্তরীণ সংকট: যে কারণে নেতানিয়াহুকে থামতে হলো

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইরানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পেছনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সামনে একাধিক কারণ ছিল। এর মধ্যে প্রধান কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রচণ্ড চাপ, কৌশলগত কারণ এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট। যদিও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা দাবি করছেন, তাদের মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে।
ইসরায়েলের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক সিমা শাইন বলেন, ইসরায়েলি সমরবিদরা শুরু থেকেই একটি স্বল্পমেয়াদী যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন। তাদের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতার ওপর আঘাত হানা, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়ানো নয়। তিনি বলেন, 'ইসরায়েল প্রায় দুই সপ্তাহের একটি সংক্ষিপ্ত অভিযানের পরিকল্পনা করেছিল। যুদ্ধবিরতি হয়েছে ১২ দিনের মাথায়, পরিকল্পনার চেয়ে কিছুটা আগেই।'
শাইন আরও উল্লেখ করেন, গাজা বা লেবাননের অভিযান থেকে এটা আলাদা ছিল। তার মতে, এটি ছিল একটি ভিন্ন ধরনের যুদ্ধ। ইসরায়েল সরকার যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, তার বেশিরভাগই অর্জিত হয়েছে। আর যা অর্জন করা যায়নি—অর্থাৎ, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প পুরোপুরি নির্মূল করা—তা সম্ভবত অর্জনযোগ্যই ছিল না।'
ইসরায়েলের একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছেন, ইসরায়েল ধারণা করেছিল অভিযানের শুরুতেই ইরান সরকার অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে কিন্তু পতন হবে না। তাই পারমাণবিক কর্মসূচির যতটা সম্ভব ক্ষতি ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। যখন বোঝা গেল এর চেয়ে বেশি কিছু অর্জন সম্ভব নয়, তখন ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ
সিমা শাইন বলেন, যদিও ইসরায়েল আগে থেকেই অভিযান শেষ করার পরিকল্পনা করে রেখেছিল, কিন্তু যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তটি যে ট্রাম্প প্রশাসনের চাপেই নেওয়া হয়েছে, তা স্পষ্ট।
ওয়াশিংটনের লক্ষ্য ছিল, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে দ্রুত দেশটির সক্ষমতা পঙ্গু করে দেওয়া এবং সংঘাত যেন আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ না নেয় তা নিশ্চিত করা। তাই হামলার পরপরই যুদ্ধবিরতির আলোচনা জরুরি ছিল। শাইন বলেন, 'ট্রাম্পের জন্য এই হামলা ছিল একটি সংক্ষিপ্ত সামরিক ব্যবস্থা, যা তাকে যুদ্ধে না জড়িয়েই সামনে এগোনোর সুযোগ করে দেয়।'
ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলায় ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে ইসরায়েলজুড়ে বিলবোর্ড লাগানো হয়। এমন পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহুর পক্ষে মার্কিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা কঠিন ছিল।
যুদ্ধবিরতি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মার্কিন চাপের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর ইরান থেকে তিনটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ঘটনায় ইসরায়েল বড় আকারের পাল্টা হামলার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ট্রাম্পের চাপে নেতানিয়াহু কেবল পশ্চিম ইরানের একটি রাডার সাইটে সীমিত হামলা চালাতে রাজি হন।
জানা যায়, ট্রাম্প কঠোর ভাষায় নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেন।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও জনমত
নেতানিয়াহুর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার তৃতীয় কারণ হতে পারে তার দুর্বল রাজনৈতিক অবস্থান। অভিযানের আগে অতি-রক্ষণশীল ইহুদি তরুণদের সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করার মতো বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তার জোট সরকারের ভেতরেই তীব্র সংকট চলছিল। সেই দফায় তিনি অনাস্থা ভোটে টিকে গেলেও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিলই।
যুদ্ধের পর অবশ্য নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। চ্যানেল ১২-এর এক জরিপে দেখা গেছে, নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি এখন ইসরায়েলের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। তবে এই জনসমর্থন দীর্ঘস্থায়ী না-ও হতে পারতো।
ইরানের হামলায় অন্তত ২৮ জন ইসরায়েলি নিহত এবং প্রায় তিন হাজার মানুষ আহত হয়। দেশের অর্থনীতি প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় প্রায় এক লাখ ইসরায়েলি বিদেশে আটকা পড়েন। দেশের মানুষ আর কতদিন এই অচলাবস্থা সহ্য করত, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল।
বামপন্থী মেরেৎজ পার্টির সাবেক প্রধান নিতজান হোরোভিটজ বলেন, 'ইসরায়েলি সমাজ প্রায় দুই বছর ধরে গাজা যুদ্ধের কারণে চাপের মধ্যে রয়েছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিলেও, অভ্যন্তরীণ ক্ষয়ক্ষতি ছিল ব্যাপক।'
নেতানিয়াহু সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন, জনসমর্থন থাকতে থাকতেই যুদ্ধ শেষ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কারণ, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির কারণে সমর্থন কমার ঝুঁকি ছিল। যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম 'মারিভ' জানিয়েছে, নেতানিয়াহু তার 'মি সিকিউরিটি' ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে আগাম নির্বাচনের কথা ভাবছেন।
ইরানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পর বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ গাজাতেও যুদ্ধ শেষ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'এবার গাজায় যুদ্ধ শেষ করার সময় এসেছে। জিম্মিদের ফিরিয়ে আনুন, যুদ্ধ বন্ধ করুন। ইসরায়েলের পুনর্গঠনের কাজ শুরু করতে হবে।'
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের পর ইসরায়েল এখন হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে চাইবে। ইরান দুর্বল হয়ে পড়ায় হামাসকে কার্যকরভাবে সহযোগিতা করতে পারবে না। এতে হামাস আরও দুর্বল হবে। আমেরিকার পাশাপাশি কাতার ও মিশরও হামাসের সঙ্গে চুক্তির জন্য চাপ দিচ্ছে। এই যুদ্ধবিরতিতে দোহার ভূমিকার প্রশংসাও করেছেন ট্রাম্প। ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে মধ্যস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে কাতার।
সূত্র: আল মনিটর
Comments