‘শিশুদের কোনো দোষ নেই, যা ঘটছে তা হওয়া উচিত না’

গাজা উপত্যকার দক্ষিণে রাফাহ শরণার্থী ক্যাম্পে ঘুমন্ত শিশুদের গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিচ্ছন এক নারী। ১৪ অক্টোবর, রাফাহ সীমান্ত এলাকা। ছবি: এএফপি

পরিবারের সঙ্গে রাফাহ সীমান্ত পার হয়ে মিশরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন ১৩ বছর বয়সী ওমরান আবু আসি। গাজায় চলমান সংঘাতের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘরবাড়ি ছেড়ে গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস শহরে আসে তার পরিবার। তারা এখন ছুটছে মিশরের দিকে।

পরিবারের সঙ্গে রাফাহ সীমান্ত পার হয়ে মিশরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন ১৩ বছর বয়সী ওমরান আবু আসি। ছবি: রয়টার্স

বাবা-মায়ের উপস্থিতিতে ১৩ বছর বয়সী ওমরান রয়টার্সকে বলেন, 'আমরা এখন শহরের একটা পার্কে থাকছি। ছোট ছেলেমেয়েরা এখানে আছে, খেলছে। মাথার ওপরে প্লেন উড়ে যাচ্ছে, এদিক-ওদিক বোমার শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে এখানেও বোমা ফেলা হতে পারে। এটা অন্যায়, আমরা এখানে নিরাপদ নই।'

'যুদ্ধের জন্য শিশুরা দায়ী না, তাদের কোনো দোষ নেই। এখানে যা ঘটছে এটা ঠিক না, এটা হওয়া উচিত না,' ওমরান বলে।

২ শিশুকে নিয়ে দিশেহারা এক ফিলিস্তিনি কিশোরি। ১২ অক্টোবর, গাজা শহর। ছবি: এএফপি

ফিলিস্তিনের সংগঠন হামাস ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়। জবাবে ওই দিনই পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এর পর থেকে টানা ১১ দিন ধরে গাজায় বিমান হামলা চলছে। দুই পক্ষে নিহত হয়েছেন ৪ হাজারের বেশি মানুষ। অবরুদ্ধ গাজায় দেখা দিয়েছে চরম মানবিক সংকট।

জাতিসংঘ বলছে, গাজায় গত ১০ দিনে প্রায় ১০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়েছেন। জাতিসংঘের স্কুলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে কয়েকশ পরিবার।

গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে ইসরায়েলি হামলায় আহত শিশু। ছবিটি ১৫ অক্টোবর তোলা। ছবি: এএফপি

আল জাজিরা জানায়, ইসরায়েলের হামলায় নিহত ২ হাজার ৮০৮ ফিলিস্তিনির মধ্যে এক চতুর্থাংশ শিশু।

যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে শিশুদের শান্ত রাখতে, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে অভিভাবকরা সাধারণত ইউটিউবে ভিডিও দেখান, হোয়াটসঅ্যাপ স্বজনদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন।

তবে গত সোমবার ইসরায়েল গাজায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর অধিকাংশ অভিভাবকের সেই সুযোগ নেই। জেনারেটর চালানোর জন্য অল্প জ্বালানি সরবরাহ আছে যা দিন দিন কমে আসছে। ফলে যে মুষ্টিমেয় অভিভাবকরা ইন্টারনেট সুবিধা পেতেন তারাও এখন চিন্তিত।

ইসরায়েলি হামলার পর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এক ফিলিস্তিনি নারী ও তার সন্তান। ১৪ অক্টোবর, দক্ষিণ গাজা উপত্যকার খান ইউনিস। ছবি: রয়টার্স

মধ্য গাজা উপত্যকার দেইর আল-বালাহ এলাকায় ভারী বোমা হামলা থেকে বাঁচতে সন্তানদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে চলে এসেছিলেন এসরা (৩০)।

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, 'আমার বড় মেয়ে প্রিটির বয়স ৮ বছর। তার ৫ বছর বয়সী দুই যমজ ভাই আছে। ছোট বোন বয়স ২ বছর। বিমান হামলার শব্দে আমার বড় মেয়ে চিৎকার করে আমার দিকে ছুটে আসে। ছেলেমেয়েদের কান্না কোনোভাবেই থামাতে পারছিলাম না, তারা চিৎকার করে কাঁদছিল।'

জাতিসংঘ পরিচালিত একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে ফিলিস্তিনি শিশুরা। ছবিটি ১৫ অক্টোবর দক্ষিণ গাজা উপত্যকার খান ইউনিস এলাকায় তোলা। ছবি: এএফপি

'আমার বাচ্চারা ভয়ে কাঁপছে, তাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এ দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারছি না। তারা খেতে পারছে না। প্রিটি বেশ কয়েকবার বমিও করেছে,' বলেন তিনি।

৩০ বছর বয়সে ৫টি যুদ্ধ দেখেছেন এসরা।

'আমার সন্তানরা যে পরিস্থিতিতে বড় হচ্ছে আমি জানি এতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে বড় প্রভাব পড়ছে। আমি সেজন্য সন্তানদের কীভাবে সাপোর্ট দেওয়া যায় এ ব্যাপারে ইন্টারনেটের সাহায্য নিই,' বলেন তিনি।

চারদিকে ধ্বংসস্তুপ। কোথাও খোলা জায়গা নেই। ১৩ অক্টোবর, রাফাহ সীমান্ত। ছবি: এএফপি

তবে অবরুদ্ধ অবস্থায় সেটিও এখন আর করা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

'এই দু:খজনক পরিস্থিতিতে তারা বিনোদনের জন্য কার্টুন দেখে। আমি সবসময় তাদের বলেছি এমনভাবে দেখতে যাতে ফোনের চার্জ যেন শেষ না হয়, জরুরি সময়ে যেন ফোন করা যায়। এখন সে সুযোগও কমে আসছে,' বলেন তিনি।

জাতিসংঘ পরিচালিত একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছে ফিলিস্তিনি শিশুরা। ছবিটি ১৪ অক্টোবর দক্ষিণ গাজা উপত্যকার খান ইউনিস এলাকায় তোলা। ছবি: রয়টার্স

আল জাজিরা জানায়, গাজায় অবরুদ্ধ ২৩ লাখ মানুষের প্রায় অর্ধেক শিশু। তারা বছরের পর বছর অবরোধ ও সহিংসতা দেখছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০২২ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ছিটমহলের ৫ শিশুর মধ্যে ৪ জন হতাশা, শোক এবং আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে উঠছে।

Comments