আল জাজিরার প্রতিবেদন

যেভাবে কার্যকর হলো গাজার যুদ্ধবিরতি

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কিছুক্ষণ আগে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের উত্তর গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ফিরে আসার দৃশ্য। ছবি: এএফপি

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি গতকাল রোববার থেকে কার্যকর হয়েছে। ১৫ মাসের সহিংসতা ও গণহত্যার পর উপত্যকার ২০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনির জন্য কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে এই যুদ্ধবিরতি।

প্রথম ধাপে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিন ইসরায়েলি নারী বন্দি মুক্তি পান। সঙ্গে মুক্তি পেয়েছেন ৯০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিও।

এই ধাপে গাজায় আটক মোট ৩৩ জন জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস। ইসরায়েলও কিছু ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে। এসময় দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর ধীরে ধীরে গাজার সীমান্তে ফিরে আসার কথা রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী গাজায় ত্রাণ সহায়তা প্রবেশেরও সুযোগ দেবে ইসরায়েল।

প্রথম ধাপ সফল হলে আরও দুই ধাপে চুক্তি ও যুদ্ধবিরতির কথা রয়েছে। এই দুই ধাপ শেষে সব বন্দির মুক্তি এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজায় যুদ্ধবিরতি আনতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে গেছে অনেকগুলো পক্ষ। চলুন দেখে নেই যুদ্ধবিরতি-প্রচেষ্টার ১৫ মাসের যাত্রাপথ কেমন ছিল।

প্রথম যুদ্ধবিরতি

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে এক হাজার ২০০ জনকে হত্যা করে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস। এরপর শুরু গাজায় ইসরায়েলের পাল্টা হামলা ও গণহত্যা। ইসরায়েলি অভিযানের প্রথম ছয় সপ্তাহেই ১৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। প্রায় ১৭ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়ে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে আশ্রয় নেয়।

কাতারের মধ্যস্থতায় ২০২৩ সালের ২১ নভেম্বর চার দিনের একটি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয় ইসরায়েল ও হামাস।

৭ অক্টোবরের হামলায় ইসরায়েল থেকে ২৫০ জন জিম্মিকেও তুলে আনে হামাস। নভেম্বরের চুক্তি অনুযায়ী ১১০ জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিনিময়ে ইসরায়েল ২৪০ জনের মতো ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেয়, যাদের সবাই নারী ও শিশু।

পরে যুদ্ধবিরতি সাত দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর গাজায় আবার হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

ছবি: এএফপি

আন্তর্জাতিক মহলের চাপ

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ইসরায়েলের গণহত্যার সংবাদ ব্যাপক সেন্সর করা হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবে সারা বিশ্বেই তরুণ প্রজন্ম এ নিয়ে সরব হয়ে ওঠে। বিশ্বব্যাপী গণহত্যা-বিরোধী বিক্ষোভের খবরও আসতে শুরু করে।

বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিবাদ ও অবস্থান ধর্মঘটের আখড়া হয়ে ওঠে।

গণহত্যা চলাকালে ২০২৪ সালে আয়ারল্যান্ড, স্পেন, নরওয়েসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) মামলা করে দক্ষিণ আফ্রিকা, যা পরে বেলজিয়াম, কলম্বিয়া, তুরস্ক, মিশর, চিলি ও স্পেনসহ অন্তত ১৪টি দেশের সমর্থন পায়।

অব্যাহত থাকে যুদ্ধবিরতির আলোচনা

২০২৪ সালের মে, গাজা যুদ্ধের অষ্টম মাসে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি পাস হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

মিশর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা কায়রোতে দুই পক্ষের দাবি বিবেচনায় একটি চুক্তির খসরা তৈরি করে। ৬ মে হামাস-প্রধান ইসমাইল হানিয়া জানান, তার দল এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।

জানুয়ারিতে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির সঙ্গে সেই চুক্তির প্রায় হুবহু মিল রয়েছে।

তিনটি ধাপের চুক্তির প্রথম ধাপে ৩৩ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্ত করবে হামাস, বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগারে আটক কয়েকশ ফিলিস্তিনি বন্দিকে ৪২ দিনের মধ্যে মুক্তি দেওয়া হবে। দ্বিতীয় ধাপে, ইসরায়েল তাদের সেনাবাহিনীকে গাজা থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেবে।

কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

মে মাসের শেষদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দাবি করেন, ইসরায়েল একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। কিন্তু পরে নেতানিয়াহু জানান, তিনি এই পরিকল্পনা মেনে নেননি। গণহত্যা অব্যাহত রাখে ইসরায়েল।

ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ

২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে ইসরায়েলে হামলা চালানোর ঘোষণা দেয় লেবাননের গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। পরদিনই ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ একে-অপরকে আক্রমণ শুরু করে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে লেবাননে হামলার মাত্রা বাড়ায় ইসরায়েল। পেজার ও ওয়াকিটকি হামলার পর ২৩ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি বাহিনীর একদিনের অভিযানে ৫৫০ জনেরও বেশি নিহত হন। এর কয়েকদিন পর হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করে ইসরায়েল।

২০২৪ সালের ১ অক্টোবর দক্ষিণ লেবানন দখল করে নেয় ইসরায়েল।

বিশ্লেষক হামজে আত্তার আল জাজিরাকে বলেন, ২০২৪ সালের শুরুতেই গাজায় ইসরায়েলের লক্ষ্য পূরণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লেবাননে হিজবুল্লাহর ওপর আক্রমণ চালানোর প্রয়োজনে গাজার গণহত্যা দীর্ঘায়িত করা হয়েছে।

২৭ নভেম্বর ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, দক্ষিণ লেবানন থেকে সামরিক অবকাঠামো সরিয়ে নেয় হিজবুল্লাহ, সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় লেবাননের সরকারি বাহিনী। চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির ৬০ দিনের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই দক্ষিণ লেবানন ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু এই সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও লেবাননের সীমান্ত অঞ্চলের শহরগুলোতে ইসরায়েলি বাহিনীর উপস্থিতি অব্যাহত আছে। সেখানে হামলাও অব্যাহত রেখেছে তারা।

ছবি: এএফপি

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

২০২৪ সালের নভেম্বরে গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আইসিজে।

বেশ কিছু দেশ আদালতের এই সিদ্ধান্তকে সম্মান করার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই রায় প্রত্যাখ্যান করে এবং দেশটির কয়েকজন কর্মকর্তা আদালতকে হুমকি পর্যন্ত দেয়।

ট্রাম্পের হুমকি

২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, গাজায় আটক জিম্মিদের মুক্তি না দিলে হামাসকে 'চরম মূল্য দিতে হবে'। ডিসেম্বরের শেষে এবং জানুয়ারির শুরুতে এই হুমকি পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।

গাজা এবং লেবাননে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে ট্রাম্পের কর্মকর্তাও অংশগ্রহণ করেন।

অবশেষে চুক্তি সই

১৫ মাসের গণহত্যা শেষে এবছরের ১৫ জানুয়ারি শেষপর্যন্ত একটি চুক্তিতে রাজি হয় ইসরায়েল।

উগ্র ডানপন্থী মন্ত্রীদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও শনিবার ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা যুদ্ধবিরতি চুক্তির অনুমোদন দেয়।

১৯ জানুয়ারি রোববার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টা থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। হামাস প্রথম দিনে মুক্তি পেতে যাওয়া তিন ইসরায়েলি জিম্মির নাম প্রকাশ না করায় এসময় উল্টো গাজায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। 

জিম্মিদের নাম প্রকাশ করার পর স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ১৫ মিনিটে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

মে মাসে প্রস্তাবিত চুক্তির মতোই এই যুদ্ধবিরতি তিনটি ধাপে কার্যকর হবে। প্রথম ধাপে ৪২ দিনের মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ভেতর থেকে সরে আসবে।

ফলে ফিলিস্তিনিরা তাদের বিভিন্ন এলাকায় ফিরে যেতে পারবে এবং উপত্যকায় মানবিক সহায়তা আসা শুরু করবে। গত বছরের বেশিরভাগ সময় ইসরায়েল গাজায় ত্রাণ কার্যক্রম ব্যাহত করেছে বলে অভিযোগ জানিয়েছে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা।

আগের সব আলোচনায় হামাস যুদ্ধবিরতির শর্তাবলী মানেনি বলে অভিযোগ জানিয়েছে মার্কিন কর্মকর্তারা। কিন্তু চুক্তি সইয়ের আগমুহূর্তে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতমার বেন গভির জানান, সর্বশেষ ১৫ মাসে তিনি একাই যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে বারবার বাধা দিয়েছেন।

Comments

The Daily Star  | English

Disrupting office work: Govt employees can be punished within 8 days

The interim government has moved to amend the Government Service Act-2018 to allow swift disciplinary action against its employees who will be found guilty of disrupting official activities.

6h ago