নতুন পোপ লিও: বিভিন্ন ইস্যুতে তার অবস্থান কী

পোপ নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কখনো কয়েক মাস, এমনকি বছরও লেগে যায়। মাত্র দুই দিনের কনক্লেভে (পোপ নির্বাচনের গোপন সভা) রবার্ট ফ্রান্সিস প্রেভোস্টের নির্বাচিত হওয়ার অর্থ সিংহভাগ কার্ডিনাল (পোপ নির্বাচনকারী চার্চের প্রধান) আগে থেকেই তাকে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী হিসেবে দেখেছেন।
সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্বাচনের আগে আনুষ্ঠানিক বৈঠক ও অনানুষ্ঠানিক আড্ডায় নতুন পোপের কাছে দুটি বিষয় প্রত্যাশা করতে শোনা গেছে কার্ডিনালদের—সেগুলো হচ্ছে ঐক্য ও ধারাবাহিকতা।
কার্ডিনালদের কাছে পোপ ফ্রান্সিস বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তার উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতা ধরে রাখার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ঐক্যবদ্ধ করবেন নতুন পোপ, এই প্রত্যাশাই করছেন সবাই।
পোপ হিসেবে লিও চতুর্দশ নাম গ্রহণ করা রবার্ট ফ্রান্সিস প্রেভোস্টের ইতিহাস, তিনি ধর্মগুরু হিসেবে কেমন এবং বিভিন্ন ইস্যুতে তার অবস্থান উঠে এসেছে বিবিসি, গার্ডিয়ান ও টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে।
অভিবাসীর সন্তান: ইতিহাসের প্রথম মার্কিন পোপ
৬৯ বছর বয়সী প্রেভোস্ট ইতিহাসের প্রথম মার্কিন পোপ। তিনি ক্যাথলিকদের অগাস্টিনীয় ধর্মগোষ্ঠীর সাবেক প্রধান।
যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে বৈশ্বিক পরাশক্তি হওয়ায় এবং বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচারণা চালানোয় এই দেশ থেকে পোপ নির্বাচনের ব্যাপারে দীর্ঘদিন আপত্তি ছিল ভ্যাটিকানের। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ট্রাম্পপন্থী রক্ষণশীল কার্ডিনাল মনঃক্ষুণ্ণ হলেও পোপ লিওকে ক্যাথলিক চার্চের প্রগতিশীল অংশ স্বাগত জানাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
১৯৫৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর শিকাগোতে স্প্যানিশ ও ফ্রেঞ্চ-ইতালীয় বংশোদ্ভূত মা–বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া প্রেভোস্ট আসলে প্রথাগত মার্কিন ক্যাথলিক যাজকদের মতো না। ১৯৮১ সালে যাজক হিসেবে শপথ নেওয়ার পর রোমে পড়াশোনা করেছেন তিনি। এরপর তাকে পাঠানো হয় পেরুর এক মিশনে।

সেখানে বহু বছর তিনি চার্চের বিচারকের দায়িত্ব (বিচারিক ভিকার) পালন করেন। পাশাপাশি পেরুর তৃতীয় বৃহত্তম শহর ত্রুজিলোর একটি সেমিনারিতে ক্যাথলিক আইন, সাহিত্য ও নৈতিক আইন বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। ২০১৪ সালের নভেম্বরে তাকে বিশপ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় পেরুর উত্তরাঞ্চলীয় শহর চিকলায়োয়।
পেরুর নাগরিকত্বও আছে তার। বামপন্থী বিপ্লবী ধর্মতত্ত্ব ও অতিরক্ষণশীল খ্রিস্টানদের মধ্যে বিভক্ত পেরুর ক্যাথলিকদের যজ্ঞে তিনি একজন স্থির ও সংযত নেতার ভূমিকা পালন করেছেন বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। পেরুতে মতাদর্শের কারণে বিভক্ত বিশপদের মধ্যে তিনি এক ধরনের সামঞ্জস্য বজায় রাখতেন। সকালের প্রার্থনা শেষে দুই অংশের সহকর্মী যাজকদের নিয়েই একসঙ্গে নাশতা করতেন প্রতিদিন।
প্রেভোস্টের তৎকালীন সহযোগী ফিদেল পুরিসাকা ভিজিল এপিকে বলেন, 'শত সমস্যার মাঝেও তিনি সবসময় হাসিখুশি থাকতেন।'
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তাকে কার্ডিনাল হিসেবে নিয়োগ দেন পোপ ফ্রান্সিস। কার্ডিনাল হিসেবে মাত্র দুই বছর দায়িত্ব পালন করেই পোপ নির্বাচিত হলেন এই ধর্মগুরু।
এর আগে ভ্যাটিকানে তেমন উচ্চপদস্থ দায়িত্ব পালন করেননি প্রেভোস্ট। তিনি পন্টিফিকাল কমিশন ফর লাতিন আমেরিকার সভাপতি এবং সারা বিশ্বের নতুন বিশপদের নিয়োগ তদারকি করা 'ডিকাস্টারি ফর বিশপস'-এর প্রিফেক্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
লাতিন আমেরিকার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ও ক্যাথলিক চার্চের উচ্চমহলে সাম্প্রতিক ভূমিকার জন্যই হয়তো মার্কিন নাগরিক হয়েও সারা বিশ্বের কার্ডিনালদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন তিনি।
ফ্রান্সিসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্যই ধরে নেওয়া হচ্ছে নীতিগতভাবে সাবেক পোপের ধারাবাহিকতা ধরে রাখবেন প্রেভোস্ট।

ফ্রান্সিসের ধারাবাহিকতায় অভিবাসীপন্থী ও ট্রাম্প-বিরোধী অবস্থান
প্রেভোস্টের নিয়োগকে 'আমাদের দেশের জন্য এক মহান সম্মান' বলে আখ্যা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু ট্রাম্পের সঙ্গে প্রায় সব বিষয়েই দ্বিমত ছিল তার পূর্বসূরি ফ্রান্সের। বিশেষ করে ট্রাম্পের সীমান্ত ও অভিবাসননীতির তীব্র সমালোচনা করে গেছে প্রয়াত পোপ।
মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ নিয়ে ট্রাম্পের প্রচারণার সমালোচনা করে ২০১৬ সালে ফ্রান্সিস বলেছিলেন, 'যে ব্যক্তি শুধু দেয়াল তুলতে চায়, সেতুবন্ধন গড়তে চায় না, সে খ্রিস্টান না।'
জবাবে ট্রাম্প বলেছিলেন, 'একজন ধর্মীয় নেতা হিসেবে আরেকজনের বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা ঠিক না। এই অধিকার কোনো ধর্মগুরুর নেই।'
ধারণা করা হচ্ছে, নতুন পোপ লিও চতুর্দশও অভিবাসী, দরিদ্র ও পরিবেশ নিয়ে ফ্রান্সিসের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত।
পোপ লিও চতুর্দশ সবসময় নিজেকে 'অভিবাসী পরিবারের সন্তান' দাবি করে এসেছে। এক ইতালীয় চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'আমি যুক্তরাষ্ট্রে জন্মালেও আমার দাদা–দাদি ও নানা-নানি ছিলেন অভিবাসী।'
স্বাভাবিকভাবেই তিনি আজীবন অভিবাসীপন্থী অবস্থানই নিয়ে এসেছেন। পেরুর এক ক্যাথলিক গোষ্ঠীর সমন্বয়কারী ও প্রেভোস্টের সাবেক সহযোগী জেসুস লিওন রয়টার্সকে জানান, পেরুতে অবস্থান করা ভেনিজুয়েলার অভিবাসীদের প্রতি সবসময়ই সহানুভূতিশীল ছিলেন প্রেভোস্ট। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটিতে ১৫ লাখের বেশি ভেনিজুয়েলীয় অভিবাসী বসবাস করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের অভিবাসননীতির বিরুদ্ধেও তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক পোস্ট দিয়েছেন।
নারীদের ব্যাপারে অবস্থান
নারীদের যাজকের দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত ছিল ফ্রান্সিসের, পোপ লিও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে চার্চের এক অনুষ্ঠানে প্রেভোস্ট বলেন, 'নারীদের যাজকের দায়িত্ব দেওয়ার দাবি নিয়ে একটি কথা বলা দরকার। অনেক নারী নিজেরাই বলছেন, নারীদের এই দায়িত্ব দিলে কোনো সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা কম, বরং নতুন সমস্যা তৈরি হতে পারে।'
তবে ফ্রান্সিসের আমলে চার্চের নেতৃস্থানীয় অনেক পদেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নারীদের। নারীদের নিয়োগ বাড়ানোর এই অবস্থানকে সমর্থন দিয়েছেন প্রেভোস্ট। বলেছেন, এসব নিয়োগই প্রমাণ করে চার্চের জীবনে নারীরা 'অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান' রাখেন।

পোপ ফ্রান্সিস তার ১২ বছরের সময়কালে চার্চে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোয় অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি সিনডে (চার্চের কাউন্সিল) নারীদের ভোটাধিকার দিয়েছেন এবং চার্চের অনেক শীর্ষ পদে নারীদের নিয়োগ দিয়েছেন।
২০২৪ সালে রোমের এক কারাগারে গিয়ে নারী কয়েদিদের পা-ও ধুয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এর আগে ইতিহাসে কখনো কোনো পোপ নারীদের পা ধুয়ে দেননি।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে অবস্থান
পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারেও পোপ ফ্রান্সিসের মতোই অবস্থান নবাগত পোপের। এর আগে তিনি 'পৃথিবীর পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে' কার্যকর ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন ক্যাথলিক চার্চকে।
গত বছর এক সেমিনারে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রেভোস্ট বলেন, 'কথা নয়, এখন কাজ করতে হবে। প্রকৃতির ওপর মানুষের যেন দমনমূলক কর্তৃত্ব তৈরি না হয়।'
পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গভীর হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
এই সেমিনারটি আয়োজিত হয়েছিল পোপ ফ্রান্সিসের অনুরোধে। সেখানে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে চার্চকে 'সহানুভূতির সঙ্গে' কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এই গ্রহের প্রতি মানুষ যেমন নিষ্ঠুর ব্যবহার করছে, তা 'গভীর পাপ'।
Comments