যেভাবে রাজনীতির মঞ্চে জোহরান মামদানি

গত বছরের অক্টোবরে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন জোহরান মামদানি। তার এই ঘোষণায় অনেকে অবাক হয়েছিলেন। কারণ তখনো তিনি নিউইয়র্ক সিটির বেশিরভাগ বাসিন্দার কাছে অচেনা রাজনীতিবিদ।
কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কুইন্সের একটি ছাদ বাগানের বারে দাঁড়িয়ে মাত্র ৩৩ বছর বয়সী মামদানি ডেমোক্র্যাট দলের প্রাইমারি নির্বাচনে নিজেকে জয়ী ঘোষণা করেন। সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোর পরাজয় স্বীকার ছিল রাজনীতিতে চমকপ্রদ বাক-বদল।
যদিও র্যাঙ্কড চয়েস ভোটিংয়ের চূড়ান্ত ফলাফল ১ জুলাই প্রকাশিত হবে, তবুও মামদানির রাজনৈতিক উত্থান ইতোমধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। মামদানি যদি চূড়ান্ত বিজয়ী হন, তাহলে তিনিই হবেন নিউইয়র্ক শহরের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম, প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং কয়েক প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ মেয়র।
বিখ্যাত নির্মাতার সন্তান
উগান্ডার কাম্পালায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জোহরান মামদানি। তিনি ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব পান।
পরিবারের সঙ্গে অল্প কিছুদিন দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন থেকেছেন। তারপর মাত্র সাত বছর বয়সে নিউইয়র্ক শহরে চলে যান।
তার মা মীরা নায়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি 'মনসুন ওয়েডিং', 'দ্য নেমসেক' এবং 'মিসিসিপি মাসালা' এর মতো প্রশংসিত সিনেমা নির্মাণ করেছেন। তার বাবা মাহমুদ মামদানি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নৃতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক।
এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের শুরুতে মামদানি বিয়ে করেন সিরিয়ান-আমেরিকান শিল্পী রামা দুয়াজিকে। তারা বর্তমানে কুইন্সের অ্যাস্টোরিয়া এলাকায় বাস করছেন।
একসময় ছিলেন র্যাপার
মামদানির রাজনৈতিক বায়োডাটা বলছে, তিনি ব্রংক্স হাইস্কুল অব সায়েন্সে লেখাপড়া করেন। সেখানে তিনি স্কুলের প্রথম ক্রিকেট দল গঠন করেন। পরে তিনি ২০১৪ সালে বওডন কলেজ থেকে আফ্রিকান স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি নেন এবং সেখানে স্টুডেন্ট ফর জাস্টিস ইন ফিলিস্তিন সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
এরপর তিনি কুইন্সে একটি উচ্ছেদ প্রতিরোধ প্রকল্পে কাজ করেন, যেখানে ভাড়াটিয়াদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের হাত থেকে রক্ষা করা হতো। এই কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তার রাজনীতিতে আসা।
এর পাশাপাশি, মামদানি একজন শখের র্যাপার ছিলেন। তিনি ইয়াং কার্ডামম ও পরে মিস্টার কার্ডামম নামে মঞ্চে পরিচিত ছিলেন।
২০১৯ সালে তিনি তার নানিকে শ্রদ্ধা জানাতে 'নানি' নামে একটি গান তৈরি করেছিলেন। এই গানটি ভাইরাল হয়েছিল, যা তার মেয়র নির্বাচনের প্রচারণায় ইতিবাচক দিক হিসেবে কাজ করেছে। যদিও সমালোচকরা তার ২০১৭ সালের 'সালাম' গান নিয়ে বিভিন্ন যুক্তি দেন।
রাজনীতি শুরুর দিনগুলো
মামদানি রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন কুইন্স ও ব্রুকলিনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের প্রচারে কাজ করে। তিনি প্রথম নির্বাচিত হন ২০২০ সালে। সেবার কুইন্সের অ্যাস্টোরিয়া আসনে দীর্ঘদিনের ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকেও হারিয়ে দেন। এরপর টানা দুবার পুনর্নির্বাচিত হন।
তিনি নিউইয়র্ক রাজ্য অ্যাসেম্বলিতে ডেমোক্র্যাটিক সোশালিস্ট। তার উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে আছে—এক বছরের জন্য কয়েকটি শহরে বাস ফ্রি করার পাইলট প্রকল্প চালু। ইসরায়েলি বসতি কার্যক্রমে অনুমোদনহীন সহায়তা বন্ধে একটি প্রস্তাবনা পেশ করা।
মামদানির বিরোধীরা, বিশেষ করে কুমো আমেরিকার বৃহত্তম শহর পরিচালনায় তার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
কিন্তু মামদানি তুলনামূলক এই কম অভিজ্ঞতাকে প্রচারণার কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। মেয়র বিতর্কে বলেছেন, তিনি খুশি যে- কুমোর মতো 'দুর্নীতি, কেলেঙ্কারির' অভিজ্ঞতা তার নেই।
ভাইরাল প্রচারণা ও ভাষার বৈচিত্র্য
মামদানির প্রচারণার বড় অস্ত্র ছিল ভিডিও কনটেন্ট। বলিউড স্টাইল, ভারতীয় ঐতিহ্য ও সামাজিক বার্তায় ভরপুর ভিডিওগুলো জনপ্রিয়তা পায়।
তিনি কোনি আইল্যান্ডের বরফ ঠাণ্ডা পানিতে স্যুট পরে 'ভাড়া' স্থিতিশীল রাখার প্রতীকী স্টান্ট দেন। আরেকবার পুরো ম্যানহাটনে হাঁটেন এবং প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ফটো-ভিডিও দিয়ে তুলে ধরেন।
টিকটকে তিনি স্প্যানিশ, বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় কথা বলে নিউইয়র্কারদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন।
প্রগতিশীল প্রতিশ্রুতি
অ্যান্ড্রু কুমো অপরাধ ও কঠোর আইনশৃঙ্খলা ইস্যুতে প্রচারণা চালালেও, মামদানি প্রচার করেন মানবিক ও সামাজিক ন্যায়ভিত্তিক মডেল।
তার প্রচারণায় নিউইয়র্কবাসীর জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর জন্য বড় বড় প্রতিশ্রুতি আছে। যেমন—ফ্রি চাইল্ড কেয়ার, ফ্রি বাস পরিষেবা, বাসা ভাড়া নিয়ন্ত্রণে রাখা, কম খরচে নতুন আবাসন প্রকল্প (ধনীদের ওপর কর বাড়িয়ে) ইত্যাদি।
তার এসব প্রতিশ্রুতি ডেমোক্র্যাটিক দলের প্রগতিশীল অংশের প্রিয় প্রার্থী করে তোলে। তিনি সমর্থন পেয়েছেন অ্যালেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কার্তেজ ও বার্নি স্যান্ডার্সের মতো প্রগতিশীল নেতাদের।
ফিলিস্তিন ইস্যু ও বিতর্ক
মামদানির ফিলিস্তিনপন্থি অবস্থান নির্বাচনে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ইসরায়েলের গাজা অভিযানকে 'গণহত্যা' বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, ইসরায়েল যেন 'সবার জন্য সমান অধিকারের রাষ্ট্র' হয়, শুধু 'ইহুদি রাষ্ট্র' না।
বিরোধীরা ইসরায়েলকে নিয়ে তার এই সমালোচনাকে ইহুদি-বিদ্বেষী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিলেন।
তবে এই বক্তব্য ফিলিস্তিনিপন্থিদের মধ্যে অনুরণিত হয়েছে। তার অবস্থান অনেক মুসলিম ভোটারের সমর্থন পেয়েছে।
নির্বাচনের প্রাক্কালে সিবিএসের দ্য লেট শোতে এক সাক্ষাৎকারে উপস্থাপক স্টিফেন কলবার্ট মামদানিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অধিকারকে বিশ্বাস করেন কি না?
জবাবে তিনি বলেন, 'হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি, সব জাতির মতো, তাদের অস্তিত্বের অধিকার আছে। তবে আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখার দায়িত্বও আছে।'
বিজয় ঘোষণায় তার বক্তব্য
মঙ্গলবার বিজয় ঘোষণার বক্তৃতায় তিনি বলেন, 'আমি আমার বিশ্বাস ও মানবতার প্রতি প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসব না। তবে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—ভিন্নমতের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও সেই মতপার্থক্যকে বোঝার চেষ্টা করব।'
Comments