যুক্তরাষ্ট্রে আচমকা ‘জোহরান ঝড়’

জোহরান মামদানি
মা মীরা নায়ার ও স্ত্রী রামা দুয়াজিকে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা মঞ্চে জোহরান মামদানি। ছবি: রয়টার্স

তিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আখ্যা দিয়েছেন 'ফ্যাসিস্ট' হিসেবে। ট্রাম্প তাকে অভিহিত করেছেন 'শতভাগ পাগল কমিউনিস্ট'। তিনি কে—তা ইতোমধ্যে জেনে গেছেন বিশ্ববাসী। তিনি জোহরান মামদানি। উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় জন্ম নেওয়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত ৩৩ বছর বয়সী জোহরান এখন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি। তাকে নিয়ে ইতি ও নেতিবাচক ভাষ্য-বক্তব্যে ভরপুর মার্কিন সংবাদমাধ্যম।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাসী যখন সর্বাত্মক সংঘাতের চরম আশঙ্কায়, তখন সুদূর নিউইয়র্কে চলছিল আরেক 'যুদ্ধ'। ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু কেন্দ্রগুলোয় মার্কিন হামলার প্রেক্ষাপটে গত ২৪ জুন শেষ হয় সেই ১২ দিনের যুদ্ধ। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস।

আর সেদিনই নিউইয়র্ক শহরের আসন্ন মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে উঠে আসে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য জোহরান মামদানির নাম। এরপর প্রবল হতে থাকে জোহরান-চর্চা। আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হলে তিনিই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ও বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরের প্রথম মুসলিম মেয়র।

গত ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্ক শহরের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্যদের মধ্যে মেয়র মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে জোহরানের প্রতি সমর্থন ছিল মাত্র এক শতাংশ। এর তিন মাস পর গত ২৪ জুন দলীয় প্রার্থিতার প্রাথমিক বাছাইপর্বে জোহরানের প্রতি সমর্থন বেড়ে হয় সাড়ে ৪৩ শতাংশ।

দ্বিতীয় হন নিউইয়র্কের বর্তমান গভর্নর ও নিউইয়র্ক শহরে জন্ম নেওয়া ৬৭ বছর বয়সী প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ অ্যান্ড্রু কুমো। তিনি পান প্রায় সাড়ে ৩৬ শতাংশ ভোট।

প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন নিউইয়র্ক সিটির প্রধান অডিট কর্মকর্তা (কম্পট্রোলার) ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রগতিশীল ইহুদি নেতা ব্র্যাড ল্যান্ডার। মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের সেন্ট লুইয়ে জন্ম নেওয়া ৫৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ তরুণ জোহরানকে সমর্থন দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে হইচই পড়ে যায়।

সেই আওয়াজ আরও জোরালো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে।

জোহরানপ্রীতি

আগামী নভেম্বরে মেয়র নির্বাচনের প্রচারণায় জোহরান মামদানি যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছেন সেগুলো হচ্ছে—কম আয়ের মানুষদের জন্য কম খরচে আবাসনের ব্যবস্থা, শিশুদের দিবাযত্নকেন্দ্র, বিনামূল্যে বাস পরিষেবা, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো ইত্যাদি।

ইতিহাস বলছে—১৬২৪ সালে ডাচ উপনিবেশিকরা আটলান্টিকের পশ্চিমপাড়ে ম্যানহ্যাটন দ্বীপে যে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তুলেছিল দুই বছর পর এর নাম দেওয়া হয় নিউ আমস্টার্ডাম। ১৬৬৪ সালে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর নিউইয়র্ক নাম পায় সেটি। এরপর ধীরে ধীরে এই শহর বিস্তৃত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যকেন্দ্র হয়। জোহরানের প্রচারকর্মীরা বলছেন—এই পুরোনো শহরে এখন প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের নেতা।

জোহরান পরিষ্কার করে বলছেন—তিনি অভিবাসী। আরও বলছেন—প্রায় ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪০ শতাংশ বাসিন্দার জন্ম নিউইয়র্ক শহরের বাইরে। তিনি প্রচারণায় নিউইয়র্ককে 'সবার সাধ্যের মধ্যে সবার শহর' হিসেবে গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছেন। বিজয়ী হলে শুধু আবাসনই নয়, সুলভমূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রির উদ্যোগও নেবেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য দিয়ে দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলছেন তখন ট্রাম্পবিরোধী অবস্থান নিয়ে নিউইয়র্ককে অভিবাসন তথা শ্রমিকবান্ধব করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন জোহরান। বলছেন—'নিউইয়র্ক হবে ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রিয় শহর।'

জোহরান তার ওয়েবসাইটে বলছেন—'এই প্রচারণা সবার জন্য, যারা প্রতিবেশীর মর্যাদায় বিশ্বাস করেন এবং এই সরকারের কাজ হচ্ছে গণমানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ানো।'

এতে আরও বলা হয়েছে—নিউইয়র্ক শহর খুবই ব্যয়বহুল। জোহরান জীবনযাত্রার খরচ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তিনি এখানে সবার জীবনযাত্রাকে সহজ করার কথা বলছেন। তিনি নিউইয়র্কের সব বাসিন্দার মেয়র হতে চান। শহর থেকে জাতি-ধর্মবিদ্বেষ দূর করতে বাজেট বাড়ানোর কথাও জানাচ্ছেন। অপরাধ কমানোর কথা বলেছেন, যাতে সব মানুষ রাতে নিরাপদে কাজে যেতে বা কর্মস্থল থেকে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারেন।

গত ২৫ জুন জোহরান মামদানি সিএনএনকে বলেন, 'প্রচারণায় আমরা দেখেছি নিউইয়র্কবাসী নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের অপেক্ষায় আছেন।'

আসন্ন নির্বাচনে জোহরানকে বিজয়ী করতে কথা বলছেন—সিনেটর বার্নি স্যান্ডারস, সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন, কংগ্রেসম্যান জেরি ন্যাডলার, কংগ্রেসওম্যান আলেকসান্ড্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ, কংগ্রেসওম্যান নিদিয়া ভেলাস্কুয়েজ, অ্যাটর্নি জেনারেল লেতিতিয়া জেমস ও সাবেক কংগ্রেসম্যান জামাল বোম্যানসহ অনেকে।

জোহরান মামদানি
জনসংযোগে জোহরান মামদানি। ছবি: রয়টার্স

জোহরানভীতি

২০০১ সালে নিউইয়র্ক শহরে সন্ত্রাসী হামলায় বিশ্বখ্যাত টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়েছিল। সেসময় এই শহরে মুসলিমবিদ্বেষ চরমমাত্রা পেয়েছিল। ঠিক ২৫ বছর পর এর মেয়র পদে একজন মুসলিমকে দেখতে হচ্ছে!—এই আতঙ্কই যেন এখন জোহরানবিরোধীদের অন্যতম হাতিয়ার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে 'কমিউনিস্ট' তকমা।

নিউইয়র্ক শহরের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থিতার প্রাথমিক বাছাইপর্বে জোহরানের বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো তাকে 'ভীতিকর' মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করে।

গত ২৪ জুন দ্য আটলান্টিক লিখে—জোহরান মামদানির বিরোধীরা তাকে 'বিপদজ্জনক চরমপন্থি' হিসেবে দেখে।

পরদিন সিএনএন'র এক প্রতিবেদনে বলা হয়—জোহরানের জয় প্রভাবশালী ডেমোক্রেটদের শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। দলের প্রভাবশালী নেতা ম্যাট বেনেট সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'জোহরান মেয়র নির্বাচনে বিজয়ী হলে আমরা অন্য ডেমোক্রেটদের নিয়ে সত্যিই খুব শঙ্কায় পড়ে যাব। আবার দলীয় মনোনয়ন নিয়ে তিনি নির্বাচিত হতে না পারলেও আরেক সংকট তৈরি হবে।'

গত ২৬ জুন ওয়াশিংটন পোস্ট'র সম্পাদকীয়তে বলা হয়—মেয়র পদে 'সমাজতন্ত্রী' জোহরানের বিজয় হবে নিউইয়র্ক শহরের জন্য 'সম্ভাব্য বিপর্যয়'। তার মনোনয়ন শুধু দলের জন্যই নয় নিউইয়র্কের জন্য 'খারাপ'।

একই দিনে হারেৎজ'র এক মতামতের শিরোনামে বলা হয়—'ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর এখন ইসরায়েলিরা নতুন হুমকির ভয়ে আছে—তা হচ্ছে নিউইয়র্ক।'

দ্য গার্ডিয়ান শিরোনাম করে, 'নিউইয়র্কে প্রাথমিক সাফল্যের পর ইসলামবিদ্বেষী হামলার শিকার মামদানি।'

গত ২৭ জুন আল জাজিরা'র এক এক্সপ্লেনারের শিরোনাম হয়—'ফ্যাক্ট চেক: জোহরান মামদানি কি কমিউনিস্ট?'

সেদিন, টাইমস অব ইসরায়েল শিরোনাম করে—'ইহুদি রাজনৈতিক সংগঠকরা মামদানির নিউইয়র্ক শহরের প্রাথমিক বিজয়ের ভবিষ্যৎ পরিণতি নিয়ে ভাবছে।'

জোহরানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগগুলোর মধ্যে আছে তিনি 'ইসরায়েলবিরোধী'। তিনি তেল আবিবের পর সবচেয়ে বেশি ইহুদির বাস নিউইয়র্ক শহরে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে গাজায় ইসরায়েলের নির্মম হামলার বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন। পান 'ইহুদিবিরোধী' ও 'হামাসপন্থি' তকমাও।

তবে এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ও দলীয় ভোটে তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রগতিশীল ইহুদি নেতা ব্র্যাড ল্যান্ডার প্রথম অবস্থানে থাকা জোহরানকে আগামী মেয়র নির্বাচনে বিজয়ী করে একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দেওয়ায় মনে হচ্ছে তরুণ ইহুদিদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে।

কট্টর পুঁজিবাদী, ব্যবসায়ী, রিপাবলিকান পার্টির নেতাসহ নিজ দলের অনেকে বলছেন—জোহরানের জয় ঠেকাতে হবে। কেননা, নিউইয়র্কের মতো মহানগরীর নেতৃত্ব দেওয়ার বয়স তার হয়নি। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। এ ছাড়াও, তিনি ইসলামপন্থি ও কমিউনিস্ট।

ডেমোক্রেট পার্টির প্রার্থিতা বাছাই নির্বাচনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা অ্যান্ডু কুমো একদিকে যেমন নিজ দলে নিজের পরাজয় মেনে নিয়েছেন, অন্যদিকে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন। কেননা, তিনি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় নিউইয়র্ক শহরের মেয়রের দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা রাখেন।

বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস নিজে ডেমোক্রেট হয়েও দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গের উদাহরণ টানে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর দিনে বলেন, 'উনি দলের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে জিতবে পারলে আমি কেন পারবো না।'

তবে অ্যান্ড্রু কুমোর বিরুদ্ধে অর্থ ও যৌন কেলেঙ্কার অভিযোগ ও বর্তমান এরিক অ্যাডামসের প্রশাসনের প্রতি অনেকে নাখোশ থাকায় জোহরানবিরোধীদের আশঙ্কা—এমন পরিস্থিতিতে তারই জয় হয় কি না!

জোহরান মামদানি
ভক্তদের সামনে জোহরান মামদানি। ছবি: রয়টার্স

জোহরান 'ঝড়'

জোহরান মামদানি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন পাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলো 'রাজনৈতিক ভূমিকম্প' ও 'রাজনৈতিক বিপর্যয়' শব্দগুচ্ছ বেশি ব্যবহার করে। ডেমোক্রেটদের 'নমনীয়' অভিবাসননীতির কারণে এমন 'দুর্ঘটনা' ঘটেছে বলেও মন্তব্য করা হয় মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোর বিশ্লেষণ-পর্যালোচনায়।

তবে, জোহরান 'ঝড়' যে এখন আর শুধু মার্কিনিদের আলোচনার বিষয় নয় তা এই তরুণের বহু-ভাষিক ও বহু-মাত্রিক প্রচারণা কৌশল দেখে ধারণা করা যেতে পারে।

তিনি এমন এক 'ঝড়' যিনি এখন আলোচিত হচ্ছেন বিশ্বজুড়ে, আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আর অভিনন্দিত হচ্ছেন নিউইয়র্কজুড়ে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জনজরিপ বিভাগের ২০২৩ সালের তথ্য অনুসারে—নিউইয়র্ক শহরে বাসিন্দাদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ প্রায় ৩৪ শতাংশ, হিস্পানিক বা লাতিনো সাড়ে ২৮ শতাংশ, কৃষ্ণাঙ্গ ২২ শতাংশ ও এশীয় ১৫ শতাংশ।

পিউ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২০২৪ সালের তথ্য বলছে—নিউইয়র্ক শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে খ্রিস্টান ৫৯ শতাংশ, ইহুদি আট শতাংশ এবং মুসলিম ও হিন্দু ধর্মাম্বলী তিন শতাংশ করে। কোনো ধর্মই বিশ্বাস করেন না প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ। এদের অনেকের কাছে জোহরান এখন নিউইয়র্কের 'নতুন তারকা'।

Comments

The Daily Star  | English

Why Dhaka has become unliveable

To survive Dhaka, you need a strategy. Start by embracing the absurd: treat every crisis as a plot twist.

11h ago