ট্রাম্প ‘ত্রিশূলে’ বিদ্ধ মোদি?

'বন্ধুত্ব' টিকিয়ে রাখাই এখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 'সত্যিকারের বন্ধুত্ব' তো দূরের কথা! ট্রাম্প-শুল্ক এখন যেন আবির্ভূত হয়েছে 'ট্রাম্প-ত্রিশূল' হিসেবে। আর এই ত্রিশূলে যেন বিদ্ধ হচ্ছেন ট্রাম্পের 'সত্যিকারের বন্ধু' ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ট্রাম্প-শুল্ক ঘিরে এক এক করে অনেক দেশের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি সেরে ফেলেছে হোয়াইট হাউস। ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গেও হয়েছে সমঝোতা। কিন্তু, আপাতদৃষ্টিতে 'দিল্লি দূর অস্ত'ই থেকে যাচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসির কর্মকর্তাদের কাছে।
প্রত্যাশিত ভাবেই, গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে ভারতীয় পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক মোট ৫০ শতাংশে দাঁড়াল।
এ সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশে বলা হয়, আজ বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হবে ২৫ শতাংশ শুল্ক। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে।
মূলত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধে নয়াদিল্লির অস্বীকৃতির প্রেক্ষাপটেই এসেছে এই বাড়তি শুল্কের বোঝা।

এর আগে, একই দিনে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক সংবাদের শিরোনাম করা হয়—'ট্রাম্প চান ভারত রুশ তেল কেনা বন্ধ করুক। কিন্তু, মোদি কেন না বলছেন?' এই শিরোনাম থেকে অন্তত এটুকু বোঝা যায় যে—নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন ডিসির মধ্যে 'দূরত্ব' বাড়ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে নরেন্দ্র মোদি 'কৌশলগত' ভারসাম্যের পথে হাঁটছেন। কিন্তু, কতদিন সেই 'ভারসাম্য' ধরে রাখা সম্ভব?
এতে আরও বলা হয়—অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ট্রাম্পের 'ধৈর্যচ্যুতি' হয়েছে। তিনি এখন খুব স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছেন ভারতকে যে কোনো এক দিক বেছে নিতে হবে। কম দামে রুশ তেল কেনার বিষয়টিকে তিনি যেন 'ত্রিশূল' বানিয়ে ফেলেছেন। আর সেই ত্রিশূলেই কি বিদ্ধ করছেন মোদিকে?
নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প—দুই জনেই জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে নিজ নিজ দেশে সুবিদিত। আর দুই নেতার বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতাকে তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে 'ব্রোম্যান্স' শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এখন প্রশ্ন—সেই ভ্রাতৃত্বসূলভ রোম্যান্স কি ফিকে হয়ে যাচ্ছে?
গত সোমবার গণমাধ্যম সিএনবিসি'কে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভারতের ওপর শুল্ক 'উল্লেখযোগ্য হারে' বাড়তে পারে। কারণও বলেছেন তিনি। তা হলো—ভারত এখনো রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। যা পরবর্তীতে সত্য হয়েছে।
গত সপ্তাহে ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প জানান, ভারত তেল ছাড়াও রাশিয়া থেকে প্রচুর পরিমাণে সামরিক যন্ত্রাংশ কেনে।
যদিও সে সময় শুল্কের হার কত হবে তা ট্রাম্প জানাননি। তবে ইতোমধ্যে জানা গেছে, মোট শুল্ক ৫০ শতাংশ।
গত সপ্তাহে নতুন করে নূন্যতম ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর পর যেন নতুন করে আরও বড় 'ত্রিশূল' তাক করলেন মোদির দিকে।

কিন্তু, বিশ্বের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী ও চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারত যেন এমন হুমকির প্রতি 'ভ্রুক্ষেপ' করছে না। উল্টো বলছে—নয়াদিল্লিকে অন্যায়ভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। মোদি সরকার ট্রাম্প প্রশাসনের এমন পদক্ষেপকে 'অন্যায়' বলছে। শুধু তাই নয়, রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ সার ও রাসায়নিক পণ্য কিনছে বলেও ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—রাশিয়ার মোট অপরিশোধিত তেলের ৩৬ শতাংশ ভারত কেনে। বর্তমানে ইউক্রেন আগ্রাসনের কারণে নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত রাশিয়ার শীর্ষ তেল আমদানিকারক দেশ ভারত।
২০২২ সালে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দিলে মূলত সেই তেল কম দামে কিনতে শুরু করে চীন, ভারত ও তুরস্ক। কিন্তু, সব ক্ষোভ যেন ঝরে পড়ছে নয়াদিল্লির ওপর।
২০১৯ সালে টেক্সাসের হিউস্টনে 'হাউডি মোদি' অনুষ্ঠানে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ভারত 'কখনই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এতো ভালো বন্ধু পায়নি।'
পরের বছর ভারতের গুজরাটের আহমেদাবাদে বিশাল রাষ্ট্রীয় জনসমাবেশ 'নমস্তে ট্রাম্প'র আয়োজন করা হয়।

সেই 'মধু চন্দ্রিমা' এখন সুদূরের স্মৃতি।
গতকাল বার্তা সংস্থা রয়টার্স হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানায়, 'ভারতের সঙ্গে আলোচনায় অনেক বিষয়ে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু, কোনো চুক্তি হয়নি।'
দেশ দুইটির দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৯০ বিলিয়ন ডলার।

গত ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছিলেন ভারত আসন্ন শরতের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে চায়। ২০৩০ সালের মধ্যে দুই দেশের বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন ডলার করতে আগ্রহী নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটন।
দেশ দুইটির মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি ৪৭ বিলিয়ন ডলার। ঘাটতি কমাতে ভারতকে ২৫ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার আহ্বান জানানো হয়েছে।
দুই দেশের আলোচনায় সংশ্লিষ্ট সাবেক মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি মার্ক লিন্সকট বার্তা সংস্থাটিকে বলেন, 'এক পর্যায়ে দুই পক্ষই চুক্তির খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল।' তার মতে, দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ না থাকায় বিষয়টি ভেস্তে গেছে।
গত ৭ মে শুরু হওয়া ভারত-পাকিস্তানের চার দিনের যুদ্ধ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়েছিল কিনা তা নিয়ে নয়াদিল্লির সোজাসাপটা জবাব, 'না'। কিন্তু, ট্রাম্প ক্রমাগত তাই বলে চলেছেন। মোদি সেই যুদ্ধের সাফল্য নিতে চেয়েছিলেন বা এখনো নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে, ট্রাম্প-কাঁটায় বারবার বিঁধতে হচ্ছে তাকে।
শুধু তাই নয়। ট্রাম্প নিজেই পাকিস্তান নিয়ে অনেক আশাবাদ শুনিয়েছেন। ভারতের চিরশত্রুর এমন প্রশংসা প্রিয় বন্ধুর মুখে শুনে নিশ্চয় নাখোশ নরেন্দ্র মোদি। ট্রাম্প আরও একধাপ এগিয়ে বলে বসেন—পাকিস্তান একদিন ভারতে তেল বিক্রি করতে পারে।
ধরে নেওয়া যেতে পারে—এসবই ট্রাম্প-মোদি সম্পর্কের উত্তাপ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।

এক জ্যেষ্ঠ ভারতীয় কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা সংস্থাটিকে জানান, শীর্ষ ভারতীয় পরামর্শকরা চুক্তি আলোচনার প্রক্রিয়াটি নিয়ে ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারেননি। তার ভাষ্য, 'ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সন্তোষজনক চুক্তির পর আমরা যথাযথ কূটনৈতিক সমর্থন পাইনি। আমরা যে সংকটে পড়েছি তা এড়াতে পারতাম।'
ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে ভারত চিরবন্ধু রাশিয়া থেকে তেল কেনা কিছুটা কমাতে পারে। তবে, মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি মার্ক লিন্সকট মনে করেন, মোদি ও ট্রাম্পের মধ্যে সরাসরি কথা বলা দরকার। তার ভাষ্য, 'ফোন হাতে নিন। এখন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু, সবাইকে খুশি রেখে বাণিজ্য চুক্তি করার সম্ভাবনা আছে।'
বিষয়টি যদি এতই সহজ হয় তাহলে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে কেন কথা বলছেন না মোদি? তিনি কি ট্রাম্প-ত্রিশূলে বিদ্ধ?
Comments