‘ফিলিস্তিনিদের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত রাখার গল্প’

গাজায় স্থল বা নৌপথে ত্রাণ প্রবেশ কার্যত বন্ধ রেখেছে ইসরায়েল। শুধু গত ২৩ মাসের গণহত্যামূলক অভিযান চলাকালীন সময়ে নয়, আরও অনেক আগে থেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার দুর্দশাগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে নানা বাধাবিপত্তি তৈরি করে এসেছে ইসরায়েল।
গাজায় 'ইসরায়েলের অবৈধ আগ্রাসনের' অবসান ঘটাতে চান সুইডেনের স্বনামধন্য পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। তিনি দাবি করেছেন, এটা নিছক কোনো সমুদ্র অভিযানের গল্প নয়। এটা ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চনার উপাখ্যান।
এই লক্ষ্য হাতে নিয়ে প্রায় ২০টি নৌযানের 'ফ্লোটিলা' (ভাসমান যানের বহর) নিয়ে তিনি ও আরও অসংখ্য মানবাধিকার ও ত্রাণ কর্মী রওনা হয়েছেন গাজার পথে।
আজ রোববার এই তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি, রয়টার্স ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
ত্রাণ ফ্লোটিলার অভিযানের বিস্তারিত
স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৩ টায় (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা) স্পেনের বন্দর নগরী বার্সেলোনা থেকে ২০টি নৌযানের বহর রওনা হয়েছে।

এই উদ্যোগের আয়োজন করেছে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নামের সংগঠন। তারা 'গাজায় একটি মানবিক করিডর চালু ও ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান গণহত্যা বন্ধের' অঙ্গীকার করেছে।
আরবিতে সুমুদ শব্দের অর্থ 'সহনশীলতা' বা টিকে থাকার সক্ষমতা।
ওয়েবসাইটে নিজেদেরকে একটি নিরপেক্ষ সংগঠন বলে দাবি করেছে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। কোনো দেশের সরকার বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই।
ফ্লোটিলাটি ফিলিস্তিনি পতাকা বহন করছে। এতে রয়েছে ১০-১২টি দেশ থেকে আসা শত-শত মানুষ। আরোহীদের মধ্যে অধিকারকর্মী ও সাধারণ জনগণের পাশাপাশি আইরিশ অভিনেতা লিয়াম কানিংহাম ও স্পেনের এডুয়ার্ড ফার্নান্দেজও আছেন।
বার্সেলোনার সাবেক মেয়র আদা কোলাউ সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আইনপ্রণেতা ও সুপরিচিত মানুষও এই ফ্লোটিলার যাত্রী।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নৌযানের বহরটি গাজার উপকূলে ভেড়ার আশা করছে।
অভিযানের লক্ষ্য
গণমাধ্যমকে থুনবার্গ বলেন, 'আমরা কেন সাগর পাড়ি দিচ্ছি, সেটা নিয়ে প্রশ্ন করার কিছু নেই। এটা সমুদ্র অভিযানের গল্প নয়।'
'এটা ফিলিস্তিনের গল্প। কিভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাগুলো থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে—এটা সেই গল্প। (এত কিছুর পরও) গোটা বিশ্ব কিভাবে নিশ্চুপ রয়েছে, এটা সেই গল্প', বলেন তিনি।

এইচবিওর টিভি সিরিজ 'গেম অব থ্রোনস' এর দাভোস চরিত্রে রূপদানকারী কানিংহাম বলেন, 'আপনারা যে এখানে আছে, এই ফ্লোটিলা যে যাত্রা শুরু করল, এটাই প্রমাণ করছে যে বিশ্ব আজ আন্তর্জাতিক ও মানবিক আইনের বাস্তবায়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। এবং এটি ইতিহাসের একটি লজ্জাজনক অধ্যায়। সমষ্টিগতভাবে আমাদের সবার লজ্জা পাওয়া উচিত।'
৪ সেপ্টেম্বর তিউনিসিয়া ও ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর থেকে আরও ১০-১৫টি নৌযান ত্রাণ ফ্লোটিলায় যোগ দেবে বলে আয়োজকরা আশা করছেন।
ফ্লোটিলা অভিযানের পাশাপাশি ৪৪টি দেশে অধিকারকর্মীরা 'ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ' করে যুগপৎ বিক্ষোভে অংশ নেবে বলে জানান ফ্লোটিলার স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য থুনবার্গ।
গত সপ্তাহে বার্সেলোনায় ব্রাজিলের মানবাধিকারকর্মী তিয়াগো আভিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, 'এটাই হবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংহতির অভিযান। এর আগে যতবার এ ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, তার চেয়েও এবার অনেক বেশি মানুষ ও নৌযান এতে অংশ নেবে।'
পর্তুগালের আইনপ্রণেতা মারিয়ানা মরতাগা বলেন, 'আমরা যতটুকু বুঝেছি, এটি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী একটি বৈধ অভিযান।'
মারিয়ানাও এই অভিযানে সশরীরে যোগ দেবেন।
এবারই প্রথম নয়
এর আগেও জুন ও জুলাই মাসে গাজায় ত্রাণ পৌঁছে দিতে দুইটি ফ্লোটিলা অভিযানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন মানবাধিকারকর্মীরা। তবে উভয় ক্ষেত্রেই ইসরায়েলি হস্তক্ষেপে অভিযানগুলো ভেস্তে যায়।
২০২৫ সালের ১ জুন ইতালির সিসিলির কাতানিয়া বন্দর থেকে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের আয়োজনে থুনবার্গসহ ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রাজিল, তুরস্ক, সুইডেন, স্পেন ও নেদারল্যান্ডের ১২ মানবাধিকারকর্মী মাদলিন নামের একটি নৌকা নিয়ে গাজায় প্রবেশের চেষ্টা চালান। তাদেরকে গাজার পশ্চিম উপকূল থেকে ১৮৫ কিলোমিটার দূরে আটক করে ইসরায়েলি সেনা।

এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল গাজায় ইসরায়েলের নৌ-অবরোধ ভাঙা এবং সেখানে মানবিক সহায়তা (যেমন চাল, আটা, শিশুখাদ্য এবং চিকিৎসা সামগ্রী) পৌঁছে দেওয়া, সেই সঙ্গে গাজার মানবিক সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
থুনবার্গকে আটক রাখার পর ফ্রান্সে নির্বাসন দেয় ইসরায়েল। এরপর সেখান থেকে তিনি নিজ দেশে ফিরে যান।
একই কায়দায় জুলাই মাসে ১০ দেশের ২১ মানবাধিকারকর্মী নিয়ে গাজার উদ্দেশে রওনা হয় 'হান্দালা' নামের একটি নৌযান। তবে সেবারও তাদেরকে আটকে দেয় নেতানিয়াহুর বাহিনী।
স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসে মানুয়েল আলবারেস শনিবার জানান, 'স্পেনের সরকার থুনবার্গের ফ্লোটিলায় থাকা সকল স্পেনীয় নাগরিককে নিরাপদ রাখতে দিতে সব ধরনের কূটনীতিক ও দূতাবাসকেন্দ্রিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।'
গত বছর ফিলিস্তিনকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দেয় মাদ্রিদ।
গাজার পরিস্থিতি
গত কয়েক সপ্তাহে গাজার মানবিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
জাতিসংঘ এ মাসেই গাজায় 'দুর্ভিক্ষের' ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাটি হুশিয়ারি দিয়েছে, পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ 'মহাবিপর্যয়ের' মুখে রয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাস হামলা চালিয়ে এক হাজার ২০০ মানুষকে হত্যা ও ২৫১ জনকে জিম্মি করে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে হামাসকে নির্মূলের অঙ্গীকার করেন নেতানিয়াহু।
সেদিন থেকেই চলছে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক, নির্বিচার হামলা।
ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৬৩ হাজার ৪৫৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই বেসামরিক মানুষ।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এই তথ্য জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত।
Comments