যে কৌশলে ইরানের সামরিক নেতাদের হত্যা করে ইসরায়েল

একে একে ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক নেতা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে ইসরায়েল। অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। অনেকেই তাদের নিজদের অ্যাপার্টমেন্টে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছেন।
এক সময়ের পরম বন্ধু থেকে বর্তমানে চরম শত্রুতে পরিণত হওয়া ইরানে কীভাবে বেছে বেছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়েছে তার একটি চিত্র উঠে এসেছে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে।
গত ৩০ আগস্ট প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিকটি জানায়, ইরানের নেতাদের দেহরক্ষীদের অবস্থান শনাক্ত করে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। তাদের মাধ্যমে ইরানি নেতাদের অবস্থান নিশ্চিত করা হয়। আর সেই সব তথ্য ব্যবহার করে পরে তাদেরকে একে একে হত্যা করে ইসরায়েল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইরানের নিরাপত্তাকর্মীদের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছিল।

ইরান সরকার এমন সব গোপন বৈঠকের আয়োজন করতো যা শুধু সেই বৈঠকে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরাই জানতেন। সেসব বৈঠকে দেশটির শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা ও সামরিক কমান্ডাররা যোগ দিতেন। সেসব বৈঠকের সময় ও স্থান সম্পর্কে শুধু তারাই জানতেন। কিন্তু, তাতেও তাদের রেহাই হয়নি।
গত ১৩ জুন শুরু হওয়া ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানে এক হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। তাদের মধ্যে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীর পাশাপাশি আছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাধারণ মানুষ।
যুদ্ধ চলাকালে ইরানের বেশ কয়েকটি জায়গায় উপর্যুপরি বোমা ফেলে দেশটির সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তা এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করে ইসরায়েল।
গত ১৬ জুনের একটি ঘটনা উল্লেখ করে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়—ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের চতুর্থ দিনে তেহরানের পশ্চিমে এক পাহাড়ের ঢালে ১০০ ফুট নিচের বাঙ্কারে দেশটির সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানসহ বিচার ও গোয়েন্দা বিভাগ এবং জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডাররা ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে এসে বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের কারও হাতে মোবাইল ফোন ছিল না। তারা জানতেন ইসরায়েলি গোয়েন্দারা তাদের অনুসরণ করে।
এত সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও বৈঠক শুরু হওয়ার খানিক পরেই ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো সেই বাঙ্কারে ছয়টি বোমা ফেলে। বাঙ্কারের প্রবেশপথের পাশাপাশি বের হওয়ার রাস্তাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। সেই বোমার আঘাতে বাঙ্কারের ভেতরে কেউ মারা যাননি বটে, তবে তারা বের হয়ে দেখেন তাদের দেহরক্ষীদের মরদেহ পড়ে আছে। বিস্ফোরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

হামলার অনেক পর ইরানের কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন যে তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অনেক গলদ রয়ে গেছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দারা শীর্ষ নেতাদের দেহরক্ষীদের মোবাইল ফোন হ্যাক করে সেই বৈঠকের সংবাদ পেয়েছিলেন। এই দেহরক্ষীরা বাঙ্কারের বাইরে অবস্থান করছিলেন।
ফোন ট্র্যাক করার সংবাদ আগেও বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছিল। তবে এই হামলার অন্তত দুই মাসে আগে থেকেই নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তায় থাকা ইরানের সামরিক কর্মকর্তা ও গোয়েন্দাদের নিবিড়ভাবে অনুসরণ করা হচ্ছিল।
ইরান ও ইসরায়েলের কর্মকর্তারা বলছেন যে ইরানের সেইসব নিরাপত্তাকর্মীরা গত কয়েক বছর মোবাইল ফোন যথেচ্ছ ব্যবহার করেছিলেন। তারা মোবাইল ফোন থেকে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করতেন। সেই সূত্র ধরেই এগিয়েছিল ইসরায়েলের বিমান বাহিনী। ফলে ইরানের নিরাপত্তাকর্মীদের এই খামখেয়ালিপনার জন্য মূল্য দিতে হয় তাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের।
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সাবেক সরকারি কর্মকর্তা সাসান কারিমি গণমাধ্যমটিকে বলেন, 'আমরা জানি যে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও সামরিক কমান্ডাররা ফোন বহন করেন না। তাদের গাড়িচালক, নিরাপত্তাকর্মী ও অন্যদের সঙ্গে ফোন থাকে। তারা সতর্কতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। তাই তাদেরকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়।'
এ বিষয়ে ইসরায়েলের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, 'বেশি বেশি দেহরক্ষী রাখা দুর্বলতার প্রমাণ। আর আমরা সেই দুর্বলতাকেই কাজে লাগিয়েছি।'
Comments