আলোচনায় গাজায় ৫ বছর বয়সী শিশু হত্যাকে ঘিরে নির্মিত সিনেমা

গত বছর গাজায় ইসরায়েলি সেনার গণহত্যামূলক হামলার বশবর্তী হয়ে নিহত হয় একটি পাঁচ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি শিশু। ওই মেয়েটির হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে নির্মিত সিনেমা 'দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব (হিন্দ রজবের কণ্ঠস্বর)' আজ ভেনিস চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে দেখানো হবে।
আজ বুধবার এই তথ্য জানিয়েছে এএফপি।
ইতোমধ্যে এই সিনেমার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন হলিউডের দুই স্বনামধন্য অভিনেতা ব্র্যাড পিট ও হোয়াকিন ফিনিক্স।
চলচ্চিত্র উৎসবে গণহত্যা নিয়ে বিক্ষোভ
ইতালির ভেনিসে চলছে ৮২তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এবারের আসরে বড় আলোচনার বিষয় ছিল গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা। হাজারো মানুষ শনিবার ওই অনুষ্ঠানের ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন। সমবেত কণ্ঠে তারা বলে ওঠেন 'গণহত্যা বন্ধ করুন।'

এর আগে চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজকদের কাছে দুই হাজার মানুষ খোলা চিঠি দিয়ে প্রকাশ্যে ইসরায়েলি সরকারের নিন্দা জানানোর আহ্বান জানান। তারা সবাই চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
তবে তাদের আহ্বানে সাড়া না দিলেও আয়োজকরা 'দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব' প্রদর্শনের অনুমতি দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ১১ দিনের অনুষ্ঠানে শীর্ষ পুরষ্কারের অন্যতম দাবিদার হতে যাচ্ছে এই মর্মস্পর্শী সিনেমা।
পরিচালক বেন হানিয়া
সিনেমার পরিচালক কাউথার বেন হানিয়া। তিনি তিউনিসিয়ার নাগরিক। বেড়ে উঠেছেন ফ্রান্সে। পিট ও ফিনিক্সের পাশাপাশি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে এতে কাজ করেছেন 'দ্য জোন অব ইন্টারেস্ট' খ্যাত পরিচালক জনাথান গ্লেজার।

মহরতের আগে অনুষ্ঠানে উপস্থিতদের বেন হানিয়া বলেন, 'এই সিনেমার কেন্দ্রে আছে এমন একটি বিষয়, যা খুবই সরল। কিন্তু একইসঙ্গে, ওই বিষয়টি জানার পর সহজ-স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আমি এটা মেনে নিতে পারছি না যে পৃথিবী এখন এমন এক জায়গা যেখানে একটি শিশু সাহায্যের জন্য কেঁদে উঠার পরও কেউ এগিয়ে আসে না।'
শিশু রজবের হত্যাকাণ্ড
ইসরায়েলের নির্বিচার ও গণহত্যামূলক হামলার মুখে পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে শিশু রজব ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য গাজা সিটি ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। এটা ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের ঘটনা।

গার্ডিয়ান ও ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন মতে, ২৯ জানুয়ারির ওই ঘটনায় কালো রঙের কিয়া পিকানটো গাড়িতে রজবের সঙ্গে তার পরিবারের ছয় সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন চাচা বাশার হামাদা, চাচী ও তাদের চার সন্তান।
গাড়ির ওপর ইসরায়েলি সেনারা সরাসরি হামলা চালালে রজবের পরিবারের বাকিরা সবাই ঘটনাস্থলেই নিহত হন। কিন্তু সে বেঁচে যায়। পরিবারের সদস্যরা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে রজব। কিন্তু কিভাবে যেন একটি মোবাইল ফোন খুঁজে পায় সে। সেটি তখনো কার্যকর ছিল।
বারবার কল করে অসহায়ের মতো সাহায্য চাইতে থাকে রজব। দাতব্য সংস্থা রেড ক্রিসেন্টের উদ্ধারকারী দলের কাছে আসা ওই কলগুলোর রেকর্ড করে রাখা হয়। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত সাহায্য চেয়েছিল সে।
পরবর্তীতে কল রেকর্ড প্রকাশ পেলে আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় বয়ে যায়।
রজবের শেষ কথা ছিল, 'আমি অনেক ভয় পাচ্ছি, দয়া করে আপনারা আসুন'। এরপর আর তার সঙ্গে রেড ক্রিসেন্টের কর্মীরা যোগাযোগ করতে পারেনি।

ফোন পেয়েই একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠায় সংস্থাটি। কিন্তু রজবকে বাঁচাতে যাওয়া দুই সাহসী উদ্ধারকর্মীও রক্ষা পায়নি। তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
১২ দিন পর রজব ও তার পরিবারের বাকি সদস্যদের মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে রেড ক্রিসেন্টের ওই দুই কর্মীর মরদেহও ছিল—তারা রজবকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেরাও প্রাণ হারান।
বেন হানিয়া তার সিনেমায় ফোন রেকর্ডের কথাগুলো দর্শকদের শুনিয়েছেন। তবে তিনি রেড ক্রিসেন্টের এক কাল্পনিক কর্মীর মাধ্যমে পুরো গল্পটি বর্ণনা করেন।
বেন হানিয়া মন্তব্য করেন, 'কখনো কখনো আপনারা চোখের সামনে যা দেখেন না, সেটাই বেশি ভয়ংকর।'
ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের পরিচালক আলবের্তো বারবেরা অঙ্গীকার করেন, এই সিনেমাটি 'দর্শক ও সমালোচকদের ওপর সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলবে'।
যুদ্ধ বন্ধের আশাবাদ
রজবের মায়ের আশাবাদ, এই সিনেমা গাজার গণহত্যামূলক হামলা বন্ধে নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। প্রায় দুই বছরের আগ্রাসনে ৬৩ হাজার ৬৩৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের সিংহভাগই বেসামরিক মানুষ।
উইসাম হামাদা এএফপিকে ফোনে বলেন, 'আমি আশা করব এই সিনেমাটি ধ্বংসাত্মক আগ্রাসন বন্ধ করবে এবং গাজার অন্য শিশুদের প্রাণ বাঁচাবে।'
তিনি এখন তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে গাজা সিটিতে চরম দুর্দশার মধ্যে বসবাস করছেন।

রজবের মা আরও বলেন, 'গোটা বিশ্ব আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমরা মারা যাচ্ছি, ক্ষুধার্ত থাকছি, আতংকের মধ্যে বসবাস করছি আর নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছি। কেউ, কিছুই করছে না।'
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, এখনো রজবের মৃত্যুর ঘটনাটি 'এখনো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে'।
ইসরায়েলি বাহিনী রজবের মৃত্যু নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তদন্ত পরিচালনা করেনি।
Comments