শিশুর এডিএইচডি কী, জানুন লক্ষণ, ঝুঁকি ও চিকিৎসা
আপনার শিশু সন্তান প্রায়ই বই-খাতা হারিয়ে ফেলছে? শিখে যাওয়া জিনিস লিখতে ভুল করছে? অনেক বেশি চঞ্চল আর অস্থির, মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না? এগুলো কিন্তু হতে পারে এডিএইচডির লক্ষণ।
এডিএইচডি কী এবং এটি থাকলে করণীয় কী সে সম্পর্কে জেনে নিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সানজিদা আহমেদের কাছ থেকে।
শিশুর এডিএইচডি কী
ডা. সানজিদা বলেন, অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডারের সংক্ষিপ্ত রূপ এডিএইচডি বা শিশুর অতি চঞ্চলতা ও অমনোযোগ। এটি শিশুর বিকাশজনিত একটি সমস্যা। ১২ বছর বয়সের নিচে, বিশেষ করে ৪ থেকে ৫ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পায়।
এডিএইচডি কেন হয়
ডা. সানজিদা বলেন, প্রধানত জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণে শিশুর এডিএইচডি দেখা যায়। মস্তিষ্কের রাসায়নিক তারতম্য ও ভারসাম্যহীনতার কারণে এডিএইচডি হতে পারে। এ ছাড়া সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশু, কম ওজনের শিশু, মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণে শিশুর এডিএইচডি হতে পারে।
মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতার জন্যই শিশুর মধ্যে অতি চঞ্চলতা, অস্থিরতা দেখা দেয়। সেটি ঠিক করার জন্যই শিশুর চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি বলে জানান ডা. সানজিদা। সময়মতো ওষুধ না দিলে শিশু পিছিয়ে পড়বে।
এডিএইচডির লক্ষণ
ডা. সানজিদা বলেন, শিশুর এডিএইচডির লক্ষণগুলোকে অমনোযোগ ও চঞ্চলতা এই দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
অমনোযোগের লক্ষণ
১. শিশু খুবই অমনোযোগী থাকে। যেমন- কোনো কথা বলা হচ্ছে কিন্তু শিশুটি মনোযোগ দিতে পারছে না, মনোযোগ দিয়ে শুনছে না।
২. দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন- বই, খাতা, পেন্সিল, কলম প্রতিদিনই হারাচ্ছে।
৩. অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল করছে। যেমন- মেধা অনুযায়ী যা পারার কথা শিশুটি তা পারছে না। অথবা একটা বাক্য লিখেছে, সেখানে হয়তো একটা শব্দ বাদ পড়ে গেছে বা একটা অক্ষর উল্টো করে লিখেছে। জানার পরও ভুল করছে সে।
৪. বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে না পারছে না, বইয়ের একটা পৃষ্ঠা পড়তে গিয়ে দুই-তিনবার মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে, অন্যকিছু চিন্তা করছে।
৫. কারো সঙ্গে কথোপকথনের মাঝখানে মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে।
চঞ্চলতার লক্ষণ
১. শিশুর মধ্যে খুব অস্থিরতা থাকে, হাত-পা ছুঁড়তে থাকে।
২. এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। যেমন- স্কুলের সিটে বসে থাকার কথা কিন্তু শিশুটি তা পারছে না। বার বার উঠে যাচ্ছে, আবার বসছে।
৩. সারাক্ষণ দৌড়াচ্ছে, কোনো কারণ ছাড়াই ছুটোছুটি করা।
৪. অতিরিক্ত কথা বলা।
৫. প্রশ্ন করার আগেই উত্তর দিয়ে দিচ্ছে বা প্রশ্ন শেষ করার আগেই উত্তর দিয়ে দিচ্ছে।
৬. কোনো একটা খেলাধুলা করছে, যেখানে একজনের পরে তারটা শুরু হবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারছে না, অস্থির হয়ে উঠছে।
৭. অন্যরা কথা বলছে, তার মাঝখানে কথা শুরু করে দেওয়া।
কখন বলা যায় শিশু এডিএইচডি বা অতি চঞ্চল
ডা. সানজিদা বলেন, 'এসব লক্ষণ সব শিশুর মধ্যেই কম-বেশি থাকতে পারে। তবে কখন বলব শিশুর এডিএইচডি আছে সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন এসব লক্ষণ অতিমাত্রায় থাকবে, শিশুটির বয়স ১২ বছরের নিচে থাকবে, চঞ্চলতার মাত্রা এমন থাকবে যে অন্যদের সঙ্গে শিশুটির মেলামেশায় সমস্যা হচ্ছে, বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারছে না, স্কুলের কাজ ঠিকমতো করতে পারছে না এবং এই লক্ষণগুলো ৬ মাস আছে তখন বলা যায় শিশুটির এডিএইচডি।
তবে বিষয়গুলো দুই বা ততোধিক সেটিংয়ে হতে হবে। অর্থাৎ একটা শিশু বাসায় চঞ্চল কিন্তু স্কুলে শান্ত, অন্যদের সঙ্গে ভালো তাহলে তাকে এডিএইচডি বলা যাবে না। যখন বাসায়, স্কুল, বন্ধু কিংবা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও অতি মাত্রায় চঞ্চল, তখন তাকে এডিএইচডি বলা যাবে।
এডিএইচডির ঝুঁকি
- শিশুদের মেধা বিকাশের সময়কালে এডিএইচডির চিকিৎসা যদি সময়মতো না করা হয় তাহলে শেখার কাজে সমস্যা হয়ে যায়। শিশুটি তার মেধা অনুযায়ী অর্জন করতে পারে না। কারণ অমনোযোগ ও অস্থিরতার জন্য সে শিখতে পারে না, অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ে। তাই চিকিৎসা খুবই জরুরি।
- এডিএইচডিতে শারীরিক কোনো ঝুঁকি নেই। তবে অতি চঞ্চলতার কারণে পড়ে গিয়ে বিভিন্নভাবে ইনজুরড হতে পারে শিশুরা।
- চিকিৎসা না করলে বড় হওয়ার পরও ৬০ শতাংশ থেকে যায় এই সমস্যা।
এডিএইচডির চিকিৎসা
ডা. সানজিদা বলেন, প্রথমেই শনাক্ত করতে হবে শিশুর মধ্যে যে চঞ্চলতা, অমনোযোগ সেটি স্বাভাবিক নাকি অতিমাত্রার। অর্থাৎ এডিএইচডি কি না সেটি নির্ণয় করতে হবে।
অন্য কোনো সমস্যা যেমন- শিশুর ঘুমে সমস্যা আছে কি না, বার বার ঘুম ভাঙে কি না, নাক ডাকে কি না সেগুলো দেখতে হবে। কারণ এডিনয়েডের কারণে 'স্লিপ ডিজঅর্ডার' থাকলে এডিএইচডির মতো লক্ষণ দেখা যায় শিশুর মধ্যে। কিছু কিছু মৃগীরোগীর ক্ষেত্রেও এডিএইচডির লক্ষণ দেখা যায়। এজন্যই কারণ শনাক্ত করাটা গুরুত্বপূর্ণ।
ডায়াগনোসিস করার সময় বাবা-মা ছাড়াও স্কুলের শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকেও জানতে হবে শিশুটি সব জায়গায় একই রকম আচরণ করছে কি না।
এডিএইচডি শনাক্ত হলে কাউন্সিলিং করতে হবে, একইসঙ্গে বিহেভিয়ার মোডিফিকেশন থেরাপির ট্রেনিং দিতে হবে। চাইল্ড নিউরোলজিস্ট, থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট মিলে এই কাজটি করবেন। অস্থিরতা কমাতে ও মনোযোগ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ দিতে হবে।
যেসব খাবার প্রিজারভেটিভযুক্ত, চিনি এবং অ্যালার্জি জাতীয় সেগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন ডা. সানজিদা। এ ছাড়া বয়সে একটু বড় হলে শিশুকে নিয়মিত ব্যায়াম ও মেডিটেশন করানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে বলেন এই চিকিৎসক।
একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ হয় না। সেজন্য শিশুর মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চলতা ও অমনোযোগ দেখলে অবশ্যই চাইল্ড নিউরোলজিস্টের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
Comments