শরীর ও মনে রংয়ের প্রভাব

মধ্যরাতে প্রচণ্ড গরমে অস্থির হয়ে আপনি বারান্দায় গেলেন হাওয়া খেতে। সেখানে গিয়ে দেখলেন সাদা কাপড়ে জড়ানো কেউ বসে আছেন। তখন কি ভয় এসে দানা বাঁধবে না আপনার বুকে?
কেন রাতে সাদা রঙে আমাদের ভয়? কেনই বা শোক পালনে কালো রঙ ব্যবহার করা হয়। কিংবা আমরা কেন বলি 'লাল টুকটুকে বউ'?
রঙিন পৃথিবীতে রঙের খেলার যেন শেষ নেই। যাদের দৃষ্টিশক্তি আছে তারাই কেবল এই রঙ্গিন পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।
বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন ১৬৬৬ সালে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন, একটি স্বচ্ছ বস্তুর যার মধ্য দিয়ে সাদা আলোকরশ্মি যাবার সময় তা ৭টি রঙে বিভক্ত হয়ে যায়। তখন তিনি দেখেন, প্রতিটি রঙেরই তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। লাল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি।

চারিদিকের বিচিত্র রঙ দেখে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এটি আমাদের মস্তিষ্ক ও মনে কীভাবে প্রভাবিত করছে তা বেশিরভাগ সময়ই আমরা ধরতে পারি না। ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতি ও আচরণের ওপর রঙের প্রভাব অনেক বেশি। তবে তা ব্যক্তি ও সংস্কৃতিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়।
বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো বলেন, 'রঙের কারণে মানুষের আবেগের পরিবর্তন হয়।'
শুধু মানসিক নয়, শারীরিক ক্ষেত্রেও রঙের প্রভাব এত বেশি যে, প্রাচীন মিশর ও চীনে সুস্থতার জন্য রঙের ব্যবহার করা হতো। যাকে বলা হয় 'ক্রোমোথেরাপি'।
তাই কোন রঙ আমাদের শরীর ও মনের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে তা নিয়েই আজকের আলোচনা।
লাল
লাল রঙ বিপ্লব ও ভালবাসার রঙ। লাল রঙ শৌর্যবীর্য ও সাহসিকতার প্রতীক। তীব্র উজ্জ্বলতা কারণে সহজেই এই রঙ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে বলে বিশ্বব্যাপী ট্রাফিক লাইট হিসেবে ও অ্যাম্বুল্যান্সের লাইট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এই রঙ শরীরের অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি এবং স্নায়ুকোষকে উদ্দীপ্ত করে। লাল রঙ মেটাবলিজম বাড়াতে পারে বলে বেশির ভাগ রেস্টুরেন্টেই লাল রঙকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, লাল রঙয়ের পোশাক পরিহিত নারীদের প্রতি পুরুষরা একটু বেশি আকৃষ্ট হয়ে থাকেন। কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতি বোঝাতে যেমন লাল রঙ ব্যবহৃত হয়, তেমনি ভালবাসা, তীব্র আবেগ, শক্তি বোঝাতেও লাল রঙের জুড়ি নেই। এজন্যই লাল রঙকে সবচেয়ে শক্তিশালী রঙ বলা হয়।
মানুষের কর্মক্ষমতার ওপর লাল রঙের প্রভাব আছে বলে গবেষণায় জানা যায়। যেমন- পরীক্ষার আগে কোনো শিক্ষার্থীকে লাল রঙের সংস্পর্শে রাখা হলে ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়া আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, লাল রঙের সঙ্গে গতি ও শক্তির সম্পর্ক আছে, যা খেলাধুলার সময় বেশ কাজে দেয়।
নীল
নীল রঙ নিয়ে গান ও কবিতার শেষ নেই। এটি এমন একটি রঙ যা কেউ যদি ভালো নাও বাসে, অপছন্দ করার সুযোগ নেই। নীল প্রশান্তি, শীতলতা, বিশ্বস্ততার রঙ।
এটি মস্তিষ্কে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যা মস্তিষ্ককে শান্ত রাখতে পারে। এ কারণেই নীল আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকালে আমাদের মন ভালো হয়ে যায়। অন্যদিকে নীল আবার বিষাদেরও রঙ। পাবলো পিকাসোর 'ব্লু পিরিয়ড' থিমের ছবিগুলো একাকীত্ব, বিষণ্ণতা আর শূন্যতার অনুভূতিই দেয়। এমনকি ভ্যান গগের 'স্ট্যারি নাইটস' ছবির নীল রঙও দর্শককে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে।
গাঢ় নীল স্পষ্ট চিন্তার অনুপ্রেরণা দেয় যে কারণে কর্মক্ষেত্রে নীল রঙের ব্যবহার অনেক বেশি দেখা যায়। এটি বিশ্বস্ততার চিহ্নও বহন করে তাই চাকরিক্ষেত্রে নীল রঙের পোশাককে প্রাধান্য দেওয়া হয়। হালকা নীল বা আকাশী রঙ মনকে স্থির করে ও মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে।
হলুদ
আনন্দ, উচ্ছ্বলতা, আশাবাদ বোঝাতে হলুদ রঙ ব্যবহৃত হয়। হলুদ বন্ধুত্বেরও রঙ। তাই তো বন্ধুত্ব করার প্রস্তাবে অনেকে হলুদ গোলাপ দিয়ে থাকে।
মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নিঃসরণের হার বৃদ্ধি পেলে মনে সুখের অনুভূতি তৈরি হয়। হলুদ রঙ এই হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে। যে কারণে ইমোজি হলুদ রঙের হয় বলে মনে করা হয়। প্রাচীন সমাজে হলুদ রঙকে স্নায়ু উত্তেজক ও শরীর শুদ্ধিকারক বলে ধরা হতো। এখনো আমাদের দেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক দেশে হাত বা পায়ে ব্যথা পেলে ব্যথানাশকের প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে হলুদকে ব্যবহার করা হয়। এমনকি গায়ের রঙ উজ্জ্বল করতে কাঁচা হলুদের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।
বেগুনি
বেগুনিকে বলা হয় আভিজাত্য ও রাজকীয়তার প্রতীক। একে আধ্যাত্মিকতার বাহকও বলা হয়। এটি অন্তর্মুখী, গভীর চিন্তা ও ধ্যানের প্রতীক। প্রাচীন সময়ে, অনেক অর্থ ও পরিশ্রম করে বানানো হতো বেগুনি রঙের কাপড়। প্রকৃতিতে সরাসরি এই রঙ মেলে না বলে এটি তৈরি করতে কিছুটা খরচ বেশি হয়। সাধারণত ধনীরা এই রঙ বেশি ব্যবহার করতেন। ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের সময় বেগুনি রঙের টিকিট পছন্দ করা হয়েছিলো।

সবুজ
সবুজ উর্বরতার রঙ। সতেজতা, স্নিগ্ধতা ও প্রশান্তি বোঝাতেও সবুজের ব্যবহার রয়েছে। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, সবুজ গাছের পাতা মনকে ফুরফুরে করে তোলে ও কর্মোদ্যম বাড়ায়। গবেষণা বলছে, সবুজ রং দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
১৫ শতকের দিকে বিয়ের গাউনে সবুজ রঙের প্রাধান্য ছিল। দুশ্চিন্তা কমাতে ও ব্যথা সারাতে সবুজ রং ব্যবহৃত হয়। সবুজকে মনে করা হয় সবচেয়ে পরিপূর্ণ রঙ।
গেরুয়া
গেরুয়া রঙকে আধ্যাত্মিকতার রঙ বলা হয়। এটি পরিধান করলে মনে শান্তি আসে, কালিমা দূর করে, ধীরে ধীরে আত্মচেতনা বৃদ্ধি পায়৷ মানব জীবনে গৈরিক রঙের প্রভাব সুদূর প্রসারী। ত্যাগের অন্যতম প্রতীক এই গেরুয়া রঙ। এই জন্য সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর সঙ্গে গেরুয়া রঙটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এই রঙ অনেকটা কমলা রঙের মতই বলে ১২০০ সালে ইংরেজি অভিধানে প্রথমবারের মতো একে রঙ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। হিন্দুধর্মে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রঙ কেননা এটি ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বৌদ্ধদের কাছেও গেরুয়া রঙের উল্লেখযোগ্য তাৎপর্য রয়েছে।
কালো
কালো রঙ সব রঙের সমষ্টি। এটিকে স্বচ্ছতা ও অকপটতার প্রতীক বলা হয়। কালো রঙের বেশ কয়েকটি প্রতীকী অর্থ আছে।
জার্মান বিজ্ঞানী হারমান ভন হেলমজ বলেছেন, 'কালো হচ্ছে একটি সত্যিকারের অনুভূতি। কারণ এটি সম্পূর্ণ অনুভব করা যায় অন্ধকারেই।'
এ কারণেই শোক পালনে কালো রঙ ব্যবহার করা হয়। কিছু সংস্কৃতিতে কালো মানেই মৃত্যু ও বিপদ। প্রাচীন মিশরে জীবন ও পুনর্জন্ম বোঝাতে কালো রঙ ব্যবহৃত হতো।
অনেক সময় শক্তি ও ক্ষমতা বোঝাতেও কালো রঙের ব্যবহার আছে। বর্তমান সময়ে কালো রঙ জাঁকজমক ও আনুষ্ঠানিকতার অন্যতম অনুষঙ্গ। এজন্যই বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠান বা পার্টিতে টেলিভিশনের স্টারদের কালো পোশাকে বেশি দেখা যায়।
সাদা
সাদা শুভ্রতার রঙ, পবিত্রতা ও স্বচ্ছতার প্রতীক। পশ্চিমা বিশ্বে সাদাকে শুদ্ধতা ও সরলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যার ফলে পশ্চিমা বিশ্বে বিয়ের পোশাকে সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে আমাদের দেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাদা রঙকে শোক-সন্তাপের প্রতীক হিসেবে দেখা হয় যে কারণে বৈধব্যের রঙ হয় সাদা।
সাদা রঙ ব্যবহারে মনের স্বচ্ছতা বাড়ে। শিশুদের পবিত্রতা ও সারল্যের জন্যই তাদেরকে সাদা রঙের পোশাক বেশি পড়তে দেখা যায়। ধারণা করা হয় যাদের প্রিয় রঙ সাদা, তারা অন্যের কাছে নিজেকে সহজ, সরল, সৎ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
Comments