পুরান ঢাকার বিরিয়ানির আদ্যোপান্ত

পুরান ঢাকার বিরিয়ানি
ছবি: সংগৃহীত

বিরিয়ানি শব্দটি শুনলেই আমাদের নাকে আসে ভুবনমোহিনী সেই ঘ্রাণ, জিভে আসে জল। মোগলদের হাত ধরে ঢাকায় আসা এই খাবারটি ঢাকাকে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে। ঢাকাই কাচ্চি বিরিয়ানি কিংবা খাসির বিরিয়ানি/গরুর তেহারি- সবকিছুই বাহারি স্বাদে ভরিয়ে দেয় মন।

এই বিরিয়ানি আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবন না হলেও কালক্রমে আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে উঠেছে। তবে এর রয়েছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস।

উৎপত্তি

বিরিয়ানি শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ বিরয়ান থেকে, যার অর্থ রান্নার আগে ভেজে নেওয়া।ফারসি ভাষায় চালকে বলা হতো বিরিঞ্চি। বিরিয়ানি তৈরি করতে গেলে ঘি দিয়ে ভেজে নেওয়া হতো চাল। সেখান থেকেই বিরিয়ানি।

তবে আমাদের এখানে বিরিয়ানি কীভাবে এলো তা নিয়ে মতভেদ আছে। জনশ্রুতিতে সবচেয়ে প্রচলিত যে মত সে অনুযায়ী, সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ (যার নামে তাজমহল) একবার সেনাদের পর্যবেক্ষণ করতে এসে দেখেন তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা করুণ। তাই ঘি দিয়ে চাল ভেজে তার সঙ্গে মাংস মিশিয়ে তাদের খাওয়ানোর নির্দেশ দেন তিনি। এভাবেই নাকি গোড়াপত্তন হয় বিরিয়ানির।

হেকীম হাবীবুর রাহমানের 'ঢাকা পাচাস বারাস পাহলে' বইয়ে উল্লেখ আছে এই ঘটনা।

বইয়ে আরও বলা হয়, এরপর সম্রাট শাহজাহান একদিন সেনাদের অবস্থা অবলোকন করতে এসে ঘ্রাণ পান বিরিয়ানির। মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। তারপর বাবুর্চিকে নির্দেশ দেন রকমারি মশলাসহ বিরিয়ানি রান্না করতে।

কোনো কোনো মতে, মমতাজ মহল নয়, বরং সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহান নাকি নির্দেশ দিয়েছিলেন বিরিয়ানি রান্নার। আবার অন্য এক মতে, এর কৃতিত্ব দেওয়া হয় তৈমুর লংকে। তিনি তার সেনাবাহিনীর জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে বিরিয়ানির প্রচলন ঘটান- এমন মতও প্রচলিত রয়েছে। তবে এর কোনোটিই অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়। তবে এটা মোটের ওপর নিশ্চিত যে, মোগলদের হাত ধরেই আমরা পেয়েছি বিরিয়ানি।

রকমফের

ঢাকাই বিরিয়ানির কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবেই সেখানে চলে আসবে কাচ্চির নাম। এই রান্নাটিতে চাল আর মাংস ১:২ অনুপাতে মিশিয়ে হাড়ির মুখ বন্ধ করে একসঙ্গে রান্না করা হয়। কাঁচা থেকেই কাচ্চি। কাঁচা মাংস আর চাল একসঙ্গে রান্না হয় দেখেই এমন নাম।

কাচ্চি মূলত সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য চালু হলেও তা রাজদরবারে ছড়িয়ে পড়তেও সময় নেয়নি। উজির-নাজির কিংবা আমলাদের ঘরেও ছড়িয়ে যায় কাচ্চির স্বাদ ও সুবাস। ফলে বিরিয়ানি বলতেই কাচ্চির কথাই ভেসে উঠত সবার সামনে।

হেকীম হাবীবুর রাহমানের লেখা থেকে জানা যায়, যে খাসি দিয়ে কাচ্চি করা হতো, তার মাংসে সুঘ্রাণ আনার জন্য খাসিকে জাফরান খাওয়ানো হতো।

কাচ্চির জয়জয়কারের মধ্যেই বিরিয়ানির নানান রকমফের তৈরি হয়ে যায়। মাংস আলাদাভাবে রেঁধে নিয়ে বিরিয়ানির সঙ্গে মিশিয়ে ও ছোট ছোট করে আলু কেটে দিয়ে তৈরি করা হয় তিহারি, যা তেহারি নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হওয়ায় পুরান ঢাকায় তেহারি সাধারণত গরুর মাংস দিয়েই করা হতে থাকে। আর কাচ্চি ঐতিহাসিকভাবেই খাসির মাংসে হতো। কারণ, গরুর চেয়ে এই মাংস সেদ্ধ করা সহজ। তেহারিতে মাংস আলাদাভাবে রেঁধে বিরিয়ানির সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়ায় এর নাম হয় পাক্কি বিরিয়ানি।

পুরান ঢাকার বিরিয়ানি

পুরান ঢাকায় খ্যাতিমান কয়েকটি দোকান আছে যারা বিরিয়ানির জন্য ব্র‍্যান্ড হয়ে উঠেছে। এর বাইরে অন্যান্য দোকান তো আছেই।

১৯৩৯ সালে হাজি মোহাম্মদ হোসেনের হাতে শুরু হয় হাজি বিরিয়ানি, ১৯৬২ সালে সিরাজুল ইসলাম নান্না মিয়ার হাতে চালু হয় নান্না বিরিয়ানি ও ১৯৬৫ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ক্যান্টিনে যাত্রা শুরু ফখরুদ্দিন বিরিয়ানির। এর বাইরেও পুরান ঢাকায় বিরিয়ানির বহু দোকান রয়েছে।

কাচ্চি বিরিয়ানি এক সময় ছিল মূলত বিয়ে বাড়ির খাবার। পুরান ঢাকার একেবারে নিজস্ব খাবার ছিল এটি। বিয়ে বাড়ির বাইরে দোকানে কাচ্চি বিক্রির চল তেমন ছিল না। হাজির বিরিয়ান ছিল পাক্কি বা তেহারির ধাঁচে তৈরি খাসির বিরিয়ানি। নান্না মিয়া শুরু করেছিলেন মোরগ পোলাও দিয়ে। পরে যুক্ত হয় কাচ্চি বিরিয়ানি। ফখরুদ্দিন প্রথমে শিঙাড়া বানিয়ে শুরু করেন, বিরিয়ানি আসে আরও পরে।

লেখক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ তার এক লেখায় ঢাকায় সাধারণের জন্য নিয়মিতভাবে স্বল্পমূল্যে কাচ্চি চালু করার কৃতিত্ব দিয়েছেন ঠাঁটারিবাজারের স্টার হোটেল ও রেস্তোরাঁকে। সেটি গত শতাব্দীর ষাটের দশকের ঘটনা। এরপর নান্না ও ফখরুদ্দিনেও চালু হয় কাচ্চি।

চিনিগুঁড়া না বাসমতি

ঐতিহ্যগতভাবেই সুগন্ধি চিনিগুঁড়া চালই ছিল বিয়েবাড়ির কাচ্চিতে ব্যবহৃত চাল। পুরান ঢাকার বিরিয়ানির দোকানগুলোও তাই কাচ্চি রাঁধত চিনিগুঁড়া চাল দিয়েই। তবে গত এক দশকে এক্ষেত্রে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। শুরুটা করে কোলকাতা কাচ্চি ঘর। তারপর সুলতানস ডাইন, গ্র‍্যান্ড নবাব, কাচ্চি ভাইয়ের মতো রেস্তোরাঁগুলোও কাচ্চিতে ব্যবহার করতে শুরু করে বাসমতি চাল। এখন কাচ্চিতে বাসমতি চালের ব্যবহার দেখলে অনেকে হয়তো বিশ্বাসই করতে পারবেন না যে, কাচ্চির আদি অকৃত্রিম চাল আসলে চিনিগুঁড়া।

পুরান ঢাকা-নতুন ঢাকা

বিরিয়ানির জন্য পুরান ঢাকার খ্যাতি সর্বজনবিদিত। তবে বর্তমানে অনেক দোকানই গড়ে উঠেছে নতুন ঢাকায়। বিরিয়ানি-তেহারি-মোরগ পোলাও কিছুই বাদ নেই। তবে তাতে করে যে পুরান ঢাকার বিরিয়ানির কোনো ক্ষতি হয়েছে এমনটা বলা যায় না। শাহ সাহেবের বিরিয়ানি, মানিক চাঁনের পোলাও, হাজীর বিরিয়ানি, হানিফ বিরিয়ানি, ঝুনু পোলাও ঘরের মতো দোকানগুলো তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রেখে ব্যবসা করে যাচ্ছে।

নতুন ঢাকার জনপ্রিয় দোকানগুলোর কোনো কোনোটির শাখা গড়ে উঠেছে পুরান ঢাকায়। ইদানীংকালে ফুড ভ্লগের মতো ব্যাপার পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। সে সূত্রেও পুরান ঢাকায় নিজেদের মতো চলতে থাকা দোকানগুলো ভোক্তাদের নজরে পড়ছে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসছেন স্বাদ নিতে।

এ কথা সত্য যে, পুরান ঢাকার বিরিয়ানির নিজস্ব যে স্বাদ ছিল, এখন নতুন করে বহু দোকান হওয়ার ফলে তা আর সেভাবে নেই। সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে সামগ্রিক মান আগের তুলনায় পড়তির দিকে গেছে বলে মনে হয়। খ্যাতিমান ও পুরোনো দোকানগুলোকে নিয়েও ভোক্তাদের কারো কারো ভেতর রয়েছে অসন্তুষ্টি। নামকরা দোকানগুলোর ভেতর কোনো কোনোটি অতীতের মান ধরে রাখতে পারছে না। তবে এখনও আছে সম্ভাবনা।

সমৃদ্ধ অতীত নিয়ে আগামীকে কতটা সম্ভাবনাময় করতে পারে পুরান ঢাকার বিরিয়ানির দোকানগুলো, তা এখন দেখার বিষয়।

 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

6h ago