পুরান ঢাকার বাকরখানি ও করুণ প্রেমের গল্প

ঢাকায় ঠিক কত সাল থেকে বাকরখানি বিক্রি শুরু হয় তা সুস্পষ্টভাবে জানা না গেলেও এটুকু জানা যায় যে, পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার কাছে গড়ে উঠেছিল বাকরখানির প্রথমদিকের দোকান।
নোনতা বাকরখানি, তৈরির তন্দুর ও প্রস্তুতকরণ। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ বাকরখানি। বিভিন্ন দোকানের সামনে কাঁচের বাক্সে রাখা গোল গোল বাকরখানি ছাড়া পুরান ঢাকার মানুষের বিকেলের নাশতা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। দুধ চায়ে ডুবিয়ে বাকরখানি মুখে দিতেই স্বর্গীয় এক অনুভূতি হয় এখানকার মানুষের।

বাকরখানির মূলত দুটো প্রকরণ বেশি চোখে পড়ে। একটি নোনতা, অপরটি মিষ্টি। এ ছাড়াও রয়েছে পনির, কালোজিরা ও কিমার বাকরখানি। ঢাকায় ঠিক কত সাল থেকে বাকরখানি বিক্রি শুরু হয় তা সুস্পষ্টভাবে জানা না গেলেও এটুকু জানা যায় যে, পুরান ঢাকার লালবাগ কেল্লার কাছে গড়ে উঠেছিল বাকরখানির প্রথমদিকের দোকান।

এদিকে এমন কয়েকজন কারিগরের দেখা মেলে যারা বংশপরম্পরায় বানিয়ে চলেছেন বাকরখানি। বেশিরভাগ দোকানেই দিনে অন্তত ২০-৩০ কেজি বাকরখানি বানানো হয়ে থাকে। নাজিমউদ্দিন রোডের নাসু ফারুকের সেরা বাকরখানি নামে একটি দোকান সাত ধরনের বাকরখানি প্রস্তুত করে থেকে। মিষ্টি, নোনতা, পনির, ঘি, খাস্তা, মিষ্টি ঘি ও ঝাল বাকরখানি।

পুরান ঢাকাবাসীদের কাছে চায়ে ডুবিয়ে খাওয়ার জন্য নোনতা বাকরখানির তুলনা নেই বললেই চলে। এটি মচমচে ধরনের হয়। মিষ্টি বাকরখানির পাশাপাশি মিষ্টি ঘিয়ের বাকরখানিও রয়েছে। এতে সাদা এলাচ ব্যবহৃত হয়। তবে চমকপ্রদ আরেকটি প্রকরণ হলো ঝাল বাকরখানি, যা ঝুরা ও কিমা বাকরখানি নামেও পরিচিত।

কোরবানি ঈদের সময় প্রচুর মাংস পাওয়া যায়। এই মাংস জ্বাল দিতে দিতে ঝুরা ঝুরা হয়ে গেলে তা দিয়ে পুর দেওয়া হয় বাকরখানির। এভাবে তৈরি হয় ঝাল বাকরখানি।

বাকরখানি স্থানীয়ভাবে অনেকের কাছে পরিচিত শুকা, নিমশুকা রুটি নামে। পাতলা করে রুটি বেলে তন্দুরের ভেতর সেঁকে একটির পর একটি লোহার শিক দিয়ে রুটিগুলো তুলে নেওয়া হয়।

হেকিম হাবিবুর রহমান তার 'ঢাকা পাচাস বারাস পাহলে' গ্রন্থে 'শুকি ও নিমশুকি রুটি' তথা বাকরখানির উল্লেখ করেছেন। আরেক প্রকার বাকরখানির উল্লেখ করেছেন তিনি। নাম 'গও জোবান'। তার লেখা থেকে আমরা জানতে পারি 'কাশ্মীরি' বাকরখানির কথাও। গোল নানরুটির মতো দেখতে এই বাকরখানি হয় কয়েক স্তরযুক্ত। মুচমুচে স্বাদের এই বাকরখানিতে দেওয়া হয় তিলের বীজ।

বাকরখানি তৈরির প্রক্রিয়া নিয়েও বইয়ে আলোকপাত করেছেন হেকিম হাবিবুর রহমান।

তার লেখা থেকে জানা যায়, খামির তৈরির জন্য ময়দার ডোকে ভালোভাবে মথে নিতে হবে। এরপর ময়দার সঙ্গে মাওয়া মিশিয়ে তা এমনভাবে দলে নিতে হবে যেন তীব্র শীতের মাঝেও দলতে থাকা কারিগরের কপালে দেখা দেয় বিন্দু বিন্দু ঘাম।

বর্তমানে পুরান ঢাকার কারিগররা ময়দা, তেল/ ডালডা, পানি ও তন্দুর ব্যবহার করে বাকরখানি তৈরি করে থাকেন। এজন্য প্রথমে সব উপকরণ মিশিয়ে খামির তৈরি করে নিতে হবে। এরপর সেখান থেকে ছোট ছোট কোয়া কেটে আলাদা করে নিতে হবে। এরপর বেলন দিয়ে বেলে গোলাকৃতির করে নিতে হবে। মাঝখান বরাবর ছুরি দিয়ে লম্বা তিনটি দাগ দিয়ে নিতে হবে। এরপর সামান্য পানির প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেয়ালে আটকে দিতে হবে।

এরপর ৫ থেকে ৭/৮ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এর ভেতরই তৈরি হয়ে যাবে সুস্বাদু বাকরখানি।

তবে বাকরখানি আজ বহু মানুষের প্রিয় ও পুরান ঢাকার ঐতিহ্যে পরিণত হলেও এর নেপথ্যে আছে বিয়োগান্তক এক প্রেমকাহিনী। নাজির হোসেনের লেখা 'কিংবদন্তীর ঢাকা' বইয়ে আছে এই করুণ কাহিনীর উল্লেখ।

সুবাদার শাসনের সময় বাংলার মসনদে আসীন তখন মুর্শিদকুলি খাঁ। তুরস্কের অধিবাসী তরুণ আগা বাকের ভাগ্যের অন্বেষণে আসেন ভারতবর্ষে। নাম লেখান সেনাবাহিনীতে। নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে মুর্শিদকুলি খাঁর সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন হন তিনি। কথিত আছে, সে সময়ের বিখ্যাত গায়িকা ও নৃত্যশিল্পী খনি বেগমের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল আগা বাকেরের।

কিন্তু উজিরে আলা জাহান্দর খাঁর পুত্র জয়নুল খাঁর দৃষ্টি পড়ে খনি বেগমের ওপর। এ নিয়ে বাকেরের সঙ্গে লড়াই বেঁধে যায় তার। জয়নুল খাঁ পালিয়ে যান। কিন্তু রটে যায়, আগা বাকের জয়নুলকে হত্যা করে লাশ গুম করেছেন। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ বাকেরকে শাস্তি দেন। তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বাঘের খাঁচায়। কিন্তু জ্যান্ত বাঘের সঙ্গে লড়ে বিজয়ী হয়ে বেরিয়ে আসেন আগা বাকের।

এই লড়াই চলার পূর্ণ সুযোগ নেন জয়নুল খাঁ। খনি বেগমকে অপহরণ করে ভাটি বাংলার গহীন অরণ্যে পালিয়ে যান তিনি। অনমনীয় খনি বেগমকে কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে আটকে রাখেন চন্দ্রদ্বীপে (আজকের বরিশাল)। এই সংবাদ পৌঁছে যায় বাকেরের কাছে।

সেনাপতি কালা গাজীকে নিয়ে খনি বেগমকে মুক্ত করতে ছুটে যান বাকের। জয়নুল খাঁর বাবাও ছেলেকে শাস্তি দিতে আসেন চন্দ্রদ্বীপে। তার তরবারির আঘাতেই মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছে যান জয়নুল খাঁ। কিন্তু যাওয়ার আগে ছুরি বসিয়ে দেন খনি বেগমের বুকে।

খনি বেগমের মৃত্যু হয়। শোকে পাগলপ্রায় বাকের সেখানেই থাকতে শুরু করেন। এরপর এক সময় উমেদপুরের জমিদারি লাভ করেন তিনি। সেলিমাবাদ ও চন্দ্রদ্বীপের নিয়ন্ত্রণও আসে তার হাতে। ১৭৯৭ সালে ইংরেজ শাসনামলে তার নামেই বর্তমান বরিশাল জেলার নামকরণ করা হয়েছিল বাকেরগঞ্জ। পরে অবশ্য মুর্শিদকুলি খাঁর উৎসাহে অন্যত্র বিয়ে করেছিলেন বাকের। সেখানে তার দুই পুত্র আগা সাদেক ও মির্জা মাহদীর জন্ম হয়।

তবে খনি বেগমের স্মৃতি কখনোই মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি বাকের। তাই তার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত রুটি ধরনের খাবারটির নাম রাখেন 'বাকের-খনি'। সেটি কালক্রমে পরিচিত হয় বাকরখানি নামে।

আনিস আহমেদের এক লেখা থেকে জানা যায়, মুঘল আমল থেকেই এই খাবারের প্রচলন পুরান ঢাকায় ছিল। সে সময় দুধরনের বাকরখানি পাওয়া যেত। গোল ও গাওজোবান। গাও অর্থ গরু ও জোবান অর্থ জিহ্বা। গরুর জিভের আকৃতির হওয়ায় এমন নাম।

হেকিম হাবিবুর রহমান তার 'ঢাকা পাচাস বারাস পেহলে'তে উল্লেখ করেছেন, 'ঢাকা ছাড়া সমগ্র হিন্দুস্তানের কোথাও হিন্দু রুটিওয়ালারা বাকরখানি তৈরি করে না। ঢাকা শহরে এটি এত বিখ্যাত যে, সমগ্র বাংলায় এখান থেকে তা সওগাত হিসেবে প্রেরণ করা হয়।'

 

Comments