গ্যাসলাইটিং: এক ধরনের মানসিক শোষণ

মানুষের নেতিবাচক আচরণ হিসেবে শব্দটির প্রচলন শুরু হয় একটি নাটকের মাধ্যমে
গ্যাসলাইটিং: এক ধরনের মানসিক শোষণ
ছবি: সংগৃহীত

'তুমি তো কিছুই বোঝো না', 'আরেহ বোকা', 'তোমাকে দিয়ে এসব জটিল কাজ হবে না', 'আরে ও তো শিল্পী মানুষ, এসব হিসাব বুঝবে নাকি!'– এমনই আরও অনেক কটূক্তি আমাদের আশেপাশে প্রায়ই ঘুরপাক খায়। শুনে একটু মন খারাপ হয় কিন্তু প্রতিবাদ করার মতো 'যথেষ্ট' কি না, বুঝে উঠতে না পেরে মুখ বুজে থাকা। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এসব কথাবার্তাই গ্যাসলাইটিং। 

মানুষের নেতিবাচক আচরণ হিসেবে শব্দটির প্রচলন শুরু হয় একটি নাটকের মাধ্যমে। ১৯৩৮ সালে 'গ্যাস লাইট' নামে নাটকটি মঞ্চায়িত হয় এবং পরবর্তী সময়ে একই গল্প ও নাম অবলম্বনে ১৯৪০ সালে মুক্তি পায় একটি চলচ্চিত্র। অবশ্য জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় ১৯৪৪ সালের 'গ্যাস লাইট' সিনেমাটি থেকে, যাতে চার্লস বয়ার ও ইনগ্রিড বার্গ্যমান অভিনয় করেছিলেন। প্রতিটিতেই গল্পের মূল ছাঁচটা ছিল এক। একজন পুরুষ প্রোটাগনিস্ট তার স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, তার সব ভাবনাই মিথ্যা, কল্পনামাত্র– এমনকি তাদের বাড়ির গ্যাস লাইটের জ্বলা-নেভাও। তিনি বাস্তবকে অবাস্তবরূপে তার স্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করছিলেন। এমনকি স্ত্রী চরিত্রটিও এক পর্যায়ে সেসব কথা বিশ্বাস করে ফেলেন এবং নিজেকে পাগল ভাবতে শুরু করেন। 

ঠিক এমনটাই ঘটে যখন কোনো ব্যক্তি গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হন। গ্যাসলাইটিং একপ্রকার মানসিক শোষণ। বলা যায়, মানসিক শোষণের বিভিন্ন কায়দার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে গ্যাসলাইটিং। অন্যসব শোষণের মতো এ প্রক্রিয়াতেও দুটো পক্ষ থাকে। শোষক বা গ্যাসলাইটার ও শোষিত বা ভিকটিম। গ্যাসলাইটার ব্যক্তিটির চেষ্টা থাকে ভিক্টিমের মনের মধ্যে নিজেকে নিয়ে সংশয়, আত্মবিশ্বাসের অভাব– এ ধরনের বিষয়গুলো পোক্ত করে দেওয়ার। মূলত অন্য ব্যক্তির ওপর এক ধরনের মানসিক নিয়ন্ত্রণ পাবার জন্য ও নিজেকে ক্ষমতাশীল পর্যায়ে রাখার জন্যই মানুষ এমন আচরণ করে থাকে। 

কাউন্টারিং

এ ধরনের গ্যাসলাইটিংয়ে ব্যক্তি অন্যের স্মৃতি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। যেকোনো কিছু বলার পর বা কোনো মতামত দেবার পর, 'তুমি নিশ্চিত তো?', 'তুমি তো সব ভুলে যাও' – এ ধরনের কথাবার্তা নিয়মিত বলার মাধ্যমে এই চর্চাটি করা হয়। এবং এর মধ্য দিয়ে ভিক্টিম নিজেও এক সময় বিশ্বাস করে ফেলেন যে তার কিছুই মনে থাকে না, তিনি আসলে বিষয়টি ভুলে গেছেন বা ভুল বলছেন। এ ধরনের গ্যাসলাইটিংয়ের বেশ চূড়ান্তরকম উদাহরণ দেখা যায় সত্যজিৎ রায়ের 'বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম' গল্পটিতে। 

উইথহোল্ডিং

কথোপকথনে গ্যাসলাইটিংয়ের আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে 'উইথহোল্ডিং'। এর মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে ইচ্ছে করে নিষ্ক্রিয় রাখার চেষ্টা করেন, যাতে অপর ব্যক্তিটি নিজের কথা নিয়ে অতি সচেতন হয়ে পড়েন। কিংবা তার মনে হয়, তিনি কিছুই গুছিয়ে বা বুঝিয়ে বলতে পারছেন না। এতে করে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। নতুন আসা শিক্ষকদের সঙ্গে এমনটা অনেক অমনোযোগী শিক্ষার্থীই করে থাকে। 

তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা

'ট্রিভিয়ালাইজিং' বা তুচ্ছকরণ হচ্ছে অত্যন্ত স্থূল কিন্তু বহুল প্রচলিত গ্যাসলাইটিংয়ের নমুনা। অপর ব্যক্তিটিকে সারাক্ষণ হেয় করা, তাদের অনুভূতিগুলোর যথাযথ মূল্য নেই– এমনটা মনে করানোর চেষ্টা হয় এ প্রক্রিয়ায়। বন্ধুদের দল বা কর্মক্ষেত্র, এমনকি পরিবার থেকে শুরু সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নরম স্বভাবের মানুষদের সঙ্গে এমনটা করার চর্চা রয়েছে। বিষয়টিকে 'হাস্যকর' ধরে নিয়ে হাসাহাসি করার মাধ্যমে যে কারও মানসিক স্বাস্থ্যের কতটা ক্ষতি হচ্ছে, তারা কীভাবে অনেক বেশি সংশয়গ্রস্ত ও অনেক কম আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন– সেদিকে কম লোকই খেয়াল করেন। তাই হয়তো ছোটবেলায় খেলার সাথীদের ডাকা 'দুধভাত' তকমাটি অনেকেই আজীবন গায়ে নিয়ে ঘোরেন। 

ডিনায়াল বা অস্বীকৃতি

খুব সহজ ভাষায় বললে, মিথ্যা বলা। মিথ্যা বলা গ্যাসলাইটিংয়ের প্রধান হাতিয়ার। অতীতে কোনো কিছু করে বা বলে পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে সেটি একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া, অস্বীকার করা ইত্যাদি 'ডিনায়াল'-এর অংশ। নিজে মিথ্যা বলে অপর ব্যক্তিকে মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা চলে এতে। 

স্টেরিওটাইপিং বা ছাঁচিকরণ

ব্যক্তির জেন্ডার, পেশা, এলাকা ইত্যাদি নিয়ে একটা আরোপিত ধারণার চর্চাই স্টেরিওটাইপিংয়ের মূলে। যেমন ধরা যাক, 'নোয়াখালির মানুষ তো, তাই খাবার পরই চলে যাচ্ছে' বা 'মেয়ে মানুষের বুদ্ধি!' – এ ধরনের খোঁচা মারা কথাবার্তার মাধ্যমে মানুষকে প্রতিনিয়ত গ্যাসলাইট করা হয়। এতে করে ভিক্টিম যদি আবার প্রতিবাদ করে, তখন সে 'মজা বোঝে না' বলে আবার তুচ্ছ করার প্রবণতাও দেখা যায়।

চলতি জীবনে আমরা বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগে সংযুক্ত হই। বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করি। এর মধ্যে সংবেদনশীল-অসংবেদনশীল, দুই পক্ষের সঙ্গেই আমাদের পরিচয় ঘটে থাকে। চোখ বুজে বোধ হয় কেউই বলতে পারবেন না কখনো গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হননি বা মনের ভুলেও অন্যের সঙ্গে এমন আচরণ করেননি। তবে সচেতনতার কোনো সময় হয় না, যেকোনো সময়ই এসব বিষয়ে একটু সচেতন, একটু সংবেদনশীল হওয়া যায়। গ্যাসলাইটিংয়ে শিকার হলে সরাসরি প্রতিবাদ করা এবং অন্যের সঙ্গে গ্যাসলাইটিং না করার চর্চা হোক। সবার মানসিক সুস্থতা বজায় থাকুক। 

তথ্যসূত্র: ফোর্বস, হোমওয়ার্ক, নিউপোর্ট ইনিস্টিটিউট

Comments

The Daily Star  | English

Battery-run rickshaw drivers set fire to police box in Kalshi

Battery-run rickshaw drivers set fire to a police box in the Kalshi area this evening following a clash with law enforcers in Mirpur-10 area

34m ago