স্কুল শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস তৈরিতে বিশ্ব সাহিত্যের আলোচিত ১৫ উপন্যাস
উচ্চ মাধ্যমিক আর বয়ঃসন্ধিকালের সমাপ্তির সময়ে মানুষ যখন যৌবনে পদার্পণ করে, তখন সে একটু একটু করে বিশ্বকে নতুনভাবে জানতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে শেখে। এই সময়ে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে, সঠিক বই বাছাই করতে পারলে—মানুষ, জাতি, সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে জানার পথ সুগম হয়ে ওঠে।
ভারতের সাহিত্য-বিষয়ক ওয়েবসাইট 'গোবুকমার্ট' বিশ্ব সাহিত্যের আলোচিত ১৫টি উপন্যাসের একটি তালিকা তৈরি করেছে, যেগুলো কিশোরদের পাঠাভ্যাস তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। গোবুকমার্টের তালিকায় থাকা বইগুলো হলো-
অ্যালডাস হাক্সলির 'ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড'
অ্যালডাস হাক্সলির ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস 'ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড' প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে। উপন্যাসে দেখা যায়, ভবিষ্যৎ সমাজে একটি রাষ্ট্র চিকিৎসা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন কাজে লাগিয়ে নাগরিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করে। ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড উপন্যাসে স্লিপ লার্নিং, রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজি, ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং এবং সাইকোলজিক্যাল ম্যানিপুলেশন এবং এগুলো কীভাবে একটি ডিস্টোপিয়ান সমাজ তৈরিতে অবদান রাখে সে বিষয়ে ব্যাপক বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির প্রত্যাশার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। নিষিদ্ধ হওয়া বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে 'জনপ্রিয়' একটি বই এটি।
জোরা নিল হার্সটনের 'দেয়ার আইচ ওয়্যার ওয়াচিং গড'
জোরা নিল হার্সটনের উপন্যাস 'দেয়ার আইচ ওয়্যার ওয়াচিং গড' প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে। উপন্যাসটি মিশ্র শ্বেত-কৃষ্ণ বর্ণের মেয়ে জ্যানি ক্রফোর্ডকে নিয়ে লেখা। যেখানে জ্যানি নিজের পরিচয় অনুসন্ধানের যাত্রায় ভালোবাসা খুঁজে পায়, জীবনের সুখ-দুঃখ অনুভব করে এবং শান্তিতে নিজের ঘরে ফিরে আসে। বইটির প্রাথমিক বিষয়বস্তু হলো জেন্ডার এবং কীভাবে পুরুষ ও নারীর মধ্যে স্টেরিওটিপিক্যাল ধারণা নারীকে পরাধীন করে এবং পুরুষের ক্ষমতায়ন করে সেটি।
জন স্টেইনবেকের 'অব মাইস অ্যান্ড মেন'
জন স্টেইনবেকের 'অব মাইস অ্যান্ড মেন' উপন্যাসের থিম হলো বন্ধুত্ব, অর্থনৈতিক অবিচার, শক্তিহীনতা, একাকীত্ব, স্বপ্ন, অনিশ্চয়তা এবং নিষ্ঠুরতা। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটিতে দুজন বাস্তুচ্যূত অভিবাসী খামারকর্মী- জর্জ মিল্টন এবং লেনি স্মলের অভিজ্ঞতার বয়ান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহামন্দার সময় কাজের সন্ধানে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অন্যত্র চলে যায় তারা। 'অব মাইস অ্যান্ড মেন' উপন্যাসে আমেরিকান ড্রিমে বিশ্বাসের বিপর্যয় তুলে ধরা হয়েছে।
জর্জ অরওয়েলের 'অ্যানিমেল ফার্ম'
১৯৪৫ সালে প্রকাশিত অ্যানিমেল ফার্ম ব্যঙ্গাত্মক রূপকের আকারে লেখা একটি পশু খামারের গল্প। যেখানে খামারের প্রাণীদের একটি দল খামারির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে গিয়ে প্রাণীদের জন্য একটি মুক্ত, সুখী এবং সাম্যবাদী সমাজের প্রত্যাশা করে। অ্যানিমেল ফার্মের মূল বিষয় হলো, সাধারণ মানুষ কোনো একটি বিশ্বাসে অভ্যুত্থান গড়ে তোলে, শেষ পর্যন্ত তা কিছু মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। জর্জ অরওয়েল তার উপন্যাসে দেখিয়েছেন, কীভাবে নেপোলিয়ন এবং তার সহযোগী শূকর ক্ষমতায় থেকে বিপ্লবের প্রতিশ্রুতিকে বিকৃত করে।
অ্যানা ফ্রাঙ্কের 'দ্য ডায়েরি অব অ্যা ইয়াং গার্ল'
১৯৪৭ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'দ্য ডায়েরি অব অ্যা ইয়াং গার্ল' অ্যানা ফ্রাঙ্ক নামের এক ইহুদি কিশোরীর দিনলিপি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নেদারল্যান্ডস দখলের সময় ১৯৪২-৪৪ পর্যন্ত অ্যানা পরিবারের সঙ্গে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় এই ডায়েরি লেখেন। জনপ্রিয় এই বইটির থিম হচ্ছে বয়স, একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতা, কষ্ট, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, প্রেম, পরিপক্বতা এবং যৌনতা।
জে ডি স্যালিঞ্জারের 'দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই'
জে ডি স্যালিঞ্জারের জনপ্রিয় নিষিদ্ধ উপন্যাস 'দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই'। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের কিশোরটি বিপ্লবী স্বভাবের। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত, 'দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই'-এ লেখা হয়েছে হোল্ডেন ক্যালফিল্ডের জীবনের ২ দিনের বিবরণ। যেখানে বিভ্রান্ত এবং মোহগ্রস্ত ১৬ বছর বয়সী কিশোরকে প্রিপ স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং সে প্রাপ্তবয়স্কদের নকল দুনিয়ার বিরুদ্ধে সত্য অনুসন্ধানে নামে।
রাল্ফ এলিসনের 'ইনভিজিবল ম্যান'
রাল্ফ এলিসনের 'ইনভিজিবল ম্যান' প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। উপন্যাসের কথক একজন কলেজ-শিক্ষিত তরুণ। যিনি ২০ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করে দিনের পর দিন। জাতিগতভাবে বিভক্ত সমাজ তাকে মানুষ হিসেবে পরিচিতি দিতে নারাজ। উপন্যাসের মূল বিষয় হলো 'অজ্ঞতা' কীভাবে তার পরিচয়কে প্রভাবিত করে। উপন্যাসটিতে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
রে ব্র্যাডবারির 'ফারেনহাইট ৪৫১'
১৯৫৩ সালে প্রকাশিত আমেরিকান লেখক রে ব্র্যাডবারির উপন্যাস ফারেনহাইট ৪৫১ একটি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস। এই বইয়ের মূল থিম হলো- মানুষের জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার মধ্যকার দ্বন্দ্ব। উপন্যাসটিতে দেখা যায়, গাই মন্তাজ নামের একজন ব্যক্তি বই পোড়ানো ফায়ারম্যান থেকে বইপড়ুয়া বিদ্রোহীতে পরিণত হয়। তিনি এমন এক নিপীড়ক সমাজে বাস করেন যেখানে নাগরিকদের সহজ সুখ নিশ্চিতের জন্য সব ধরনের বিভ্রান্তি, দ্বন্দ্ব এবং জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করা হয়।
উইলিয়াম গোলডিংয়ের 'লর্ড অব দ্য ফ্লাইস'
১৯৫৪ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের উপন্যাস 'লর্ড অব দ্য ফ্লাইস' একদল ব্রিটিশ বালকের নির্জন দ্বীপে আটকে পড়ার গল্প। যেখানে তারা নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যেমে ধ্বংসাত্মক পরিবেশ তৈরি করে। কোনো বয়স্ক মানুষের অভাবে তারা সভ্যতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জনে ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে তারা অসৎ ও হিংস্র হয়ে পড়ে। লর্ড অব দ্য ফ্লাইস উপন্যাসের মূল থিম হলো প্রকৃতির উপর মানবজাতির প্রভাব, সভ্যতা বনাম বর্বরতা এবং মানব প্রকৃতি।
হার্পার লির 'টু কিল অ্যা মকিংবার্ড'
১৯৬০ সালে প্রকাশিত হার্পার লির টু কিল অ্যা মকিংবার্ড আধুনিক আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম একটি ক্লাসিক উপন্যাস। যেখানে স্কাউট ফিঞ্চের চোখে তুলে ধরা হয়েছে, অ্যাটিকাস ফিঞ্চের নৈতিকতার চিত্র। উপন্যাসে অ্যাটিকাস ধর্ষণের অভিযোগে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করেন। এই উপন্যাসের প্রাথমিক বিষয়বস্তু হলো ভালো ও মন্দের সহাবস্থান। টু কিল আ মকিংবার্ড জাতি, কুসংস্কার, নিরপরাধ, খ্যাতি, অভিভাবকত্বসহ বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
এস ই হিন্টনের 'দ্য আউটসাইডারস'
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত এস ই হিন্টনের উপন্যাস 'দ্য আউটসাইডারসকে' বলা হয় আধুনকি সময়ে উপন্যাস। এই বইয়ের মূল থিম হলো নিজের পরিচয় বনাম গোষ্ঠীর পরিচয় এবং দারিদ্র্য ও সহিংসতা। ১৪ বছর বয়সী কিশোর পনিবয় কার্টিসের জীবনে প্রায় ২ সপ্তাহকে ঘিরে লেখা হয়েছে এ বইটি। উপন্যাসটি এমন একটি সমাজের কথা বলা হয়েছে, যেখানে সব কিছু সঠিক এবং ভুলের মাধ্যমে বিচার করা হয়। সে সমাজে থেকে পনিবয় বিশ্বাস করে সে একজন বহিরাগত ছাড়া কিছু নায়।
স্টিফেন চবোস্কির 'দ্য পার্কস অব বিয়িং ওয়ালফ্লাওয়ার'
স্টিফেন চবোস্কির 'দ্য পার্কস অব বিয়িং ওয়ালফ্লাওয়ার' ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র চার্লি অতীতের কোনো ঘটনার কারণে সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকে এবং বর্তমান সময়ে সেখা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। উপন্যাসটিতে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে, অতীতে তিনি কীভাবে অন্যদের দ্বারা উপেক্ষিত হয়েছেন এবং সেটা তাকে প্রভাবিত করেছে। এ ছাড়া প্যাট্রিক এবং স্যামের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর কীভাবে তার জীবনে পরিবর্তন এসেছে সে বিষয়টিও দেখানো হয়েছে।
জন গ্রিনের 'লুকিং ফর আলাস্কা'
২০০৫ সালে প্রকাশিত জন গ্রিনের উপন্যাস 'লুকিং ফর আলাস্কা' আধুনিক সময়ে গল্প। যেখানে জীবনের অর্থ, আশা, শোক এবং তরুণদের সম্পর্কের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। গল্পটি মাইলস হাল্টার সম্পর্কে, যিনি কালভার ক্রিক বোর্ডিং স্কুলে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। আলাস্কার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব এবং তার মৃত্যু গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
বেকি আলবার্টালির 'সাইমন ভার্সেস হোমো স্যাপিয়েন্স এজেন্ডা'
২০১৫ সালে প্রকাশিত 'সাইমন বার্সেস হোমো স্যাপিয়েন্স এজেন্ডা' উপন্যাসটি ১৬ বছর বয়সী সাইমন স্পিয়ারের গল্প বলা হয়েছে। যার একটি বড় রহস্য রয়েছে। উপন্যাসটি পরিবার, পরিবর্তন এবং বেড়ে ওঠার বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
অ্যাঞ্জি থমাসের 'দ্য হেইট ইউ গিভ'
২০১৭ সালে প্রকাশিত কিশোর উপন্যাস 'দ্য হেইট ইউ গিভ' অ্যাঞ্জি থমাসের প্রথম উপন্যাস।
উপন্যাসটি একটি অভিযোগের ভিত্তিতে এগিয়ে চলেছে। পুলিশের বর্বরতার কারণে তার ছোটবেলার বন্ধু খলিলের কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল সে বিষয়ে। উপন্যাসটিতে 'ব্ল্যাক লাইভস মেটার' ও শিশুদের বিষয়ও উঠে এসেছে।
তথ্যসূত্র: গো বুক মার্ট
গ্রন্থনা: আসরিফা সুলতানা রিয়া
Comments